ব্যাপার টা সুরু হয়েছিল কোনো দেব দেবীর খোঁজে নয় - তবে বঙ্কিম চন্দ্রের অানন্দমঠ বইয়ের সঙ্গে সন্যাসী বিদ্রোহের যোগ বা যোগাভাব, এবং বাংলায় তখনকার সদ্যজাগরিত রাষ্ট্রচেতনা, এইসব নিয়ে কিছু অালাপ অালোচনা চলেছিল কিছুদিন হ’ল অান্তর্জালে (internet)। এই অান্তর্জাল হয়েছে অারেক ব্রহ্মান্ডব্যাপী চা-চক্র যেখানে পৃথিবীর সমস্ত সুবুদ্ধি ওর দুর্বুদ্ধি জীবি অাড্ডাবাজরা, বাঙালি-অবাঙালি-কাঙালি-মা কালী-মেহের অালি-বকখালি-মৌলালি-খাবার থালি-মিষ্টি গালি ইত্যাদি খঁাটি ও জালি মানুষ-অমানুষরা শূন্যে দোদুল্যমান অনাবাসীক এক অাড্ডাস্থলে তাদের অশরিরী উপস্থিতি জাহির করেন মাঝে মধ্যে। সেখানেই বাক্যালাপ হয় বঙ্কিমের অানন্দমঠ বিষয়ে - তবে তাকে যাথার্থ বাক্যালাপের বদলে বরং কম্পুটারে টাইপালাপ বললেও মন্দ হয় না।
যাই হোক, অানন্দমঠের সন্যাসী বিদ্রোহ থেকে এগিয়ে সত্যিকারের সন্যাসী বিদ্রোহের ঠিকানা অাজকের অান্তর্জালিক উচ্চপথগামী (cyber highway) অামাদের মত অশরিরী অাড্ডান্বেশিদের কাছে তেমন দূর্গম হয়তো নয়। সেই শূন্যপথে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে দেখি নানা রকম লোকের কায়াহীন ছায়া সামনে দোদুল্যমান অবস্থায় নাচানাচি করছে - অনেকটা সত্যজিত রায়ের সিনেমার ভুতের রাজাদের মত।
সেই নাট্টঘরের দর্শকের দলে বসে, হাতে এক কাপ অাপাতদৃষ্ট (virtual) চা - সত্যদৃষ্টে যা ফলত নয়, তাতে চুমুক দিয়ে, পেছনের তাকিয়াতে হেলান দিয়ে দেখি - তখনকার দিনের চোস্ত পাতলুন পড়ে, উঁচু কলার-দেওয়া লাল কোট চাপিয়ে গরমে ঘেমে, মুখচোখ লাল করে ওয়ারেন হেস্টিংস মহাশয় হন্ত দন্ত হয়ে হঁাটাহাঁটি করছেন - কিন্তু কোথাও পৌছোচ্ছেনা ! একসময় ঘুরে দাঁড়িয়ে অন্ধকারে কোন এক মিস্টার ঘোষকে গালাগাল দিচ্ছেন। কি ব্যাপার?
তখন দেখি, এক নাদুস নুদুস বাঙালি, গায়ে মাড় দেওয়া কড়কড়ে ইস্তিরি করা হাতকাটা ডোরা কাটা বুশ সার্ট এবং তার তলায় মালকোঁচা মারা ধুতি, হাঁটু ওবধি তুলে, পায়ে মোজা ছাড়া কালো পাম্প সু পড়ে, কাঁচুমাচু মুখে এগিয়ে এলেন, দুহাত জোড় করে - চোর চোর ভঙ্গি। সুকুমার রায় হলে নাম দিত বাঙালিথেরিয়াম। অান্দাজ করলাম, ইনিই শ্রীযুক্ত ঘোষ, যদিও বর্তমানে ওঁকে শ্রীযুক্তের বদলে শ্রীহীন বললেও হয়তো অসঙ্গত হবেনা।
ওদের শূন্যস্থ অান্তর্জালিক কথোপকথন থেকে বোঝা গেল যে হেস্টিংস মশাই ঘোষ মশাইয়ের ওপর খাপ্পা কারণ উনি কিছু একটা লিখেছেন রিপোর্টে, সন্যাসী বিদ্রোহ নিয়ে, যা হেস্টিংস মশাইয়ের পছন্দ হয়নি। ঘোষ বাবুকে বলা হয়েছিল সন্যাসী বিদ্রোহের খবর এমন ভাবে লিখতে যাতে ফকির ও সন্যাসীদের বদমাস এবং ইংরেজদের ভাল মনে হয় - কিন্তু রিপোর্ট পড়ে ওসবের বদলে রিপোর্টারকে গোমূর্খ এবং ন্যাকা মনে হয়েছে সাহেবের।
ঘোষ বাবু কাঁচুমাচু হ’য়ে বলতে চেষ্টা করছেন যে উনি অাগে খেজুরি গুড়ের ব্যাপারী ছিলেন, এবং যদিও ওকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হঠাৎ রায় বাহাদুর বানিয়ে দিয়েছেন - ইংরাজিতে রিপোর্ট লেখার অাদবটা ওনার এখনও পুরোপুরি রপ্ত হয়নি। অামি হো হো করে হেসে ওঠাতে দেখি অাওয়াজটা কানে গেছে সাহেবের - থেমে অামার দিকে ফিরে ভুরু কুঁচকে দেখতে গেলেন কে অাওযাজ করছে। অামি চুপ করে গেলাম এবং অামার নিরাকার অনুপস্থিতির মাপ না পেয়ে হেস্টিংস সাহেব অাবার ফিরলেন ওর তৎকালীন সমস্যাতে - সন্যাসী বিদ্রোহের কাহিনী লেখা নিয়ে।
অামি চিন্তা করলাম - পলাসীর যুদ্ধের পর সিরাজের কি হয়েছিল, বাংলার চাষীদের খাজনা নেবার যা চিরাচরিত পদ্ধতি ছিল তা বদলানো হল কি ভাবে, পুরোনো হিন্দু মুসলমান জমিদারদের ঝঁেটিয়ে বিদায় করে, নতুন কালেক্টারদের কেমনকরে অানা হ’ল জমিদারির খাজনা বাড়িয়ে এবং তা অাদায় করতে। বাংলাতে নতুন ধরণের ইংরেজ ঘেঁষা অামলা তৈরি হ’ল শয়ে শয়ে - যাদের অাজকালের ভাষায় এক নতুন প্রকার সহযোগী বা collaborator বলা যায়।
এই সব ভাবছি, এমন সময় দেখি সামনের দৃশ্যটি হালকা হ’য়ে মুছে গেল। না রইল হেস্টিংস, না ঘোষ মহাশয়। এবং যার নাম দিয়ে এ গল্পের শিরোনামা, দেবী চৌধুরাণী, তাঁরও নামগন্ধ নেই।
বুঝলাম, গল্পটা ক্রমশঃ প্রকাশনের রুপ নিচ্ছে।
নেপচুনদা (Neptune Srimal) বলছিল যে কেউ নাকি উপনিষদ লিখতে পারে - তনুও লিখতে পারে “মিত্রোপনিষদ”। নেপচুনদা যাই বলুন, এটা নেহাতই তনুর অান্তর্জালিক কল্পরাজ্যে অাসল দেবী চৌধুরাণীর সন্ধানের প্রথম খেপ।
No comments:
Post a Comment