Search This Blog

Thursday, October 13, 2011

বিশ্বভারতী - নারী বিভাগ

প্রবাসী পত্রিকার আষাঢ়, ১৩৩৯ সংখ্যায় প্রকাশিত

বিশ্বভারতী - নারী বিভাগ
শ্রীআশা দেবী
শান্তিনিকেতনে শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতীতে গত কয়েক বৎসর ধরিয়া যে নারী বিভাগ গড়িয়া উঠিতেছে, তাহাতে ছোট ও বড় সকল বয়সের মেয়েদের জন্য একটি সর্ব্বাঙ্গসম্পূর্ণ ও স্বাভাবিক শিক্ষা দিবার আয়োজন আরম্ভ হইয়াছে। ভবিষ্যতে এই সকল শিক্ষার আয়োজনগুলিকে সংহত করিয়া একটি মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনা করিবার সঙ্কল্প প্রতিষ্ঠাতার পনে আছে। কিন্তু যতদিন না তাঁহার এই সঙ্কল্প কার্য্যে পরিণত হয়, ততদিন মেয়েদের নানাদিক হইতে শিক্ষা লাভ করিবার যত উপকরণ ও সুযোগ বিশ্বভারতীতে পাওয়া যায়, ভারতবর্ষের অন্য কোনও নারী-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাহা সম্ভব নয়।

    ১। শিশু বিভাগ - ছয় হইতে বারো বৎসর পর্য্যন্ত বালিকারা শিশু বিভাগে পরিগনিত হইয়া থাকে। নারী-ভবনের একটি বিশেষ অংশে একজন পৃথক মেট্রনের তত্ত্বাবধানে তাহাদের থাকিবার ব্যবস্থা আছে। এই বয়সে তাহাদের বাড়িবার সময় বলিয়া তাহাদের খাদ্য, খেলাধুলা ও স্বাস্থের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হয়। তাহাদের শিক্ষা যাহাতে কেবল পাঠ্যপুস্তকে আবদ্ধ না থাকে, সেজন্য তাহাদের বহির্জগতের সহিত পরিচয় এবং হাতেকলমে শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করা হয় - বাংলা, ইংরেজী, অঙ্ক, ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদি পাঠ্য বিষয় ছাড়া তাহাদের সঙ্গীত, নৃত্য, চিত্রবিদ্যা, কাঠের কাজ, মৃৎ-শিল্প (clay-modelling), সেলাই প্রভৃতির শিক্ষারও ব্যবস্থা আছে।

২। স্কুল ও কলেজ বিভাগ - স্কুল ও কলেজ বিভাগে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাট্রিকুলেশন, ইন্টারমীডিয়েট ও বি-এ পরীক্ষার জন্য ছাত্রীদের প্রস্তুত করা হয়। এই বিভাগের ছাত্রীরা তাহাদের পরীক্ষার পাঠ্য ছাড়া সঙ্গীত, চিত্রকলা, সেলাই, বয়নশিল্প বা অন্য যে কোনও হাতের কাজে শিক্ষা গ্রহণ করিতে ইচ্ছা করেন, তাহার জন্য সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ও সুবিধা দেওয়া হয়। মেয়েদের দেখাশোনা করিবার জন্য নারীভবনে একজন মহিলা ওয়ার্ডেন ও একজন মেট্রন থাকেন, কিন্তু তাহাদের জীবন পরিচালনা করিবার ও সকল বিষয়ে নিয়ম রক্ষা করিবার ভার প্রধানতঃ তাহাদের নিজেদেরই হাতে। এইরূপে স্বায়ত্তশাসনের দায়িত্ব গ্রজণ করিয়া, সাধারণ রন্ধনশালার কার্য্যে যথাযোগ্য সাহায্য, শিশুদের সময়ানুসারে দেখাশোনা ও রোগীর সেবা প্রভৃতি কার্য্যভার লইয়া যাহাতে তাহাদের শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়, তাহাই এখানকার শিক্ষাবিধানের উদ্দেশ্য।
যাঁহারা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত না হইয়া কেবল সাধারণভাবে শিক্ষা লাভ করিতে ইচ্ছা করেন বা যে বিষয়ে তাঁহাদের বিশেষ অনুরাগ কেবল তাহারই অনুশীলন করিতে ইচ্ছা করেন, তাঁহাদের জন্যও বিশ্বভারতীর নারী-বিভাগে বিশেষ ব্যবস্থা আছে।

৩। কলাভবন - যাঁহাদের কেবলমাত্র সঙ্গীতে বা চিত্রবিদ্যায় অনুরাগ, তাঁহারা বিশ্বভারতীর কলাভবনে ছাত্রী হইতে পারেন। কলাভবনের চিত্রবিভাগের অধ্যক্ষ শ্রীযুক্ত নন্দলাল বসু ও সঙ্গীত বিভাগের অধ্যক্ষ শ্রীযুক্ত দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই বিভাগের ছাত্রীরা যদি তাঁহাদের সাধারণ শিক্ষার জন্য আর কোনও বিভাগে কোনও বিষয়ে পড়িতে ইচ্ছা করেন তাহারও সুযোগ দেওয়া হয়।

৪। বিদ্যাভবন - যাঁহারা কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত না হইয়া বিশেষভাবে কোনও বিষয়ের অধ্যয়ন বা গবেষণা করিতে ইচ্ছা করেন, তাঁহারা বিশ্বভারতীর বিদ্যাভবনের ছাত্রী বলিয়া পরিগনিত হন এবং নির্ব্বাচিত বিষয়ে তাঁহাদের শিক্ষা সমাপ্ত হইলে বিশ্বভারতী হইতে তাঁহাদের যথাযোগ্য উপাধি দেওয়া হয়। বর্ত্তমান বিশ্বভারতীর বিদ্যাভবনে নিম্নলিখিত বিষয়গুলিতে বিশেষভাবে অধ্যয়ন বা গবেষণা করিবার ব্যবস্থা ঁছে ঃ-
(১) সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য, (২) পালি ভাষা ও সাহিত্য, (৩) বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্য, (৪) হিন্দী ভাষা ও সাহিত্য, (৫) উর্দ্দু, ফার্সী, আরবী, ভাষা ও সাহিত্য, (৬) প্রাচীন ভারতেতিহাস ও কৃষ্টি, (৭) ভারতীয় মধ্যযুগে সাধনার ধারা, (৮) জৈন-দর্শন ও জৈনশাস্ত্র, (৯) ভারতীয় পাশ্চাত্য দর্শন, (১০) শিশু-মনস্তত্ত্ব ও শিশুশিক্ষা।

৫। শিল্প বিভাগ - যাঁহারা সাধারণ শিক্ষার সহিত কোনও হাতের কাজ বা অর্থকর শিল্পে শিক্ষা গ্রহণ করিতে ইচ্ছা করেন, তাঁহারা নিম্নলিখিত যে-কোন শিল্পে শিক্ষা গ্রহণ করিতে পারেন - বয়ন, রঞ্জন, মুদ্রণ, বহি-বাঁধা, গালার কাজ, চামড়ার কাজ, সেলাই, বাতিক-কাজ (batik), কাঠ-খোদাই।

৬। পল্লীসেবা বিভাগ - পাশ্চাত্য দেশে যে সকল মহিলা সমাজের সেবা বা অন্য কোনও জনহিতকর কার্য্য জীবনের ব্রত বলিয়া গ্রহণ করিতে ইচ্ছা করেন, তাঁহারা সেই সেই কার্য্যের জন্য যাহাতে আবশ্যক শিক্ষা লাভ করিতে পারেন, এমন অনেক প্রতীষ্ঠান ইউরোপে ও আমেরিকায় আছে। আমাদের দেশেও বর্ত্তমানে শিক্ষিত মেয়েদের মধ্যে এইরূপ সেবাব্রত গ্রহণ করিবার গভীর ইচ্ছা জাগিয়াছে, কিন্তু সেই ব্রগ্রহণের উপযুক্ত হইবার জন্য যেরূপ শিক্ষার প্রয়োজন সেরূপ শিক্ষা লাভ করিবার সুযোগ এক মহারাষ্ট্র প্রদেৎ ভিন্ন ভারতবর্ষে আর কোথাও নাই। বিশ্বভারতীর অন্তর্ভুক্ত “শ্রীনিকেতনে” পল্লীসেবা ও বিশেষভাবে বাংলার পল্লীগ্রামের নষ্ট স্বাস্থের যে চেষ্টা চলিতেছে সেখানে মেয়েদেরএই শিক্ষা গ্রহণ করিবার ক্ষেত্র প্রস্তুত আছে।
পল্লী বাসী নরনারী বা শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক জীবন, বা আর্থিক অনটন বা যে-কোন একটি সমস্যার সমাধানকে জীবনের ব্রত বলিয়া যে-সকল মেয়েরা গ্রহণ করিতে ইচ্ছা করেন এবং সেজন্য নিজেদের উপযুক্ত করিতে চাহেন তাঁহারা শ্রীনিকেতনের কর্ম্মীদের তত্ত্বাবধানে ও পরিচালনায় গ্রামে গ্রামে যে-সকল অনুষ্ঠান আছে তাহাদের সহিত কাজ করিয়া হাতে কলমে শিক্ষা লাভ করিতে পারেন এবং পল্লীজীবনের সমস্যা লইয়া শ্রীনিকেতনে যে নিয়মিত বক্তৃতা ও আলোচনা হয় তাহাতে যোতদান করিয়া থিওরিটিক্যাল শিক্ষা লাভ করিতেও পারেন। তাঁহাদের থাকিবার ও কাজ করিবার সুবিধার জন্য সম্প্রতি শ্রীনিকেতনে একটি পৃথক ছাত্রীনিবাস স্থাপিত হইয়াছে।
যে শিক্ষা মানব প্রকৃতির কোনও অংশের বিকাশকে খর্ব্ব না করিয়া তাহার সমগ্র বিচিত্রতাকে সহজ ও সম্পূর্ণ ভাবে বিকশিত হইবার সুযোগ দেয়, সেই শিক্ষাই বিশ্বভারতীর আদর্শ ও লক্ষ্য। সেইজন্য বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠাতা শান্তিনিকেতনে ও শ্রীনিকেতনে মেয়েদের শিক্ষার জন্য এমন একটি ক্ষেত্র প্রস্তুত করিতেছেন যেখানে তাহারা তাহাদের বুদ্ধিবৃত্তি, জ্ঞানানুরাগ, সৌন্দর্য্যবোধ, সেবা ও কর্ম্মকুশলতা, সকল দিক হইতে নিজেকে প্রকাশ করিবার ও সৃষ্টি করিবার সুযোগ পাইয়া তাহাদের শিক্ষা সম্পূর্ণ ও সার্থক করিয়া তোলে।
-----------