বিশ্বভারতীকে ঠিক পথে ঘোরানোর যদি প্রয়োনীয়তা থাকে আজও, তবে কি করে তা করা যায় তা চিন্তা করতে গিয়ে যে কয়টা প্রধান কথা মনে আসে তা হল উপাচার্য যে মানুষই হন, এবং তাঁর ইচ্ছা যাই থাকুক, তার হাতে যদি ঠিক ঠিক যন্ত্র বা অস্ত্র না দেওয়া হয়, তাহলে তার ঠিক ঠিক ভাবে পরিবরতন আনা হয়তো অসম্ভব হবে। অথচ, সেরকম যন্ত্র হয়তো প্রশাসনের হাতে তোলা যাবেনা যতক্ষন সংসদের বিশ্ব-ভারতীকে নিয়ে যে আইন করা হয়েছে, তার সংশোধন হয়। সুতরাং - এই সংশোধনে কি কি সংযোজন থাকা উচিত, আর কি কি দূরকরণ - তা খুঁতিয়ে দেখা দরকার এবং দিল্লীকে আবেদন করা দরকার, হয়তো কলকাতায় মমতাকেও। তার প্রথম পদ হিসেবে Visva-Bharati act’টা আবার পড়তে শুরু করেছি, এবং ভাবছি লীনা দির সঙ্গে বসে একটা খসড়া তৈরি করবো, ইংরিজিতে এবং বাংলাতে - দিল্লী কলকাতাকে ভবিস্যতে ঠেলা দেবার উপলক্ষে।
লিখেছিনু রামহনু নামতনু
Parliament act পড়া ও সংশোধন করার ব্যাপারে কোনই অভিজ্ঞতা নেই - কিন্তু একজন আছেন জিনি এসব কাজে অভিজ্ঞ এবং একাজে হাত মেলাতে রাজি - লীনা চ্যাটার্জী। তাঁর সঙ্গে বসে অগাস্টের আট তারিখ মাঝ রাতে, বিশ্ব-ভারতী act নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করদ হল কিছুটা। তার সঙ্গে amendment গুলোও দেখা হল, পড়া হল আবার করে HLC রিপোর্টের পনেরটি সুপারিশ। সতি্য কথা বলতে হ’লে, সেই তালিকাটি খুব ভাল ও উপযুক্ত মনে হয়েছিল যখন প্রথমবার পড়েছিলাম বেশ কিছু বছর আগে। শ্রী গোপাল গান্ধী তান লী দাকে সেই বইটির একটি কপি পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু, এই কয় বছরে শান্তিনিকেতন তথা বিশ্ব-ভারতী সম্পর্কে আমার ধারনা পাল্টেছে, জ্ঞান বেড়েছে, নানা লোকের, দপ্তরের ও বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ হ’য়েছে ও মতবিনিময় হয়েছে। সুতরাং বর্তমান পটভূমিতে - সেই পনের দফার সুপারিশ মনে হয় যথেষ্ঠ নয়। অনেক দরকারি কথা বাদ পড়েছে এবং কিছু মামুলি ব্যাপারকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে হয়তো।
এখন আমারা কি কি করা উচিত বোধ করি, এবং তার কি কি গত রাজ্যপালের পনের দফা সুপারিশে শামিল, এবং কি কি বাদ পড়েছে এবং অন্তর্ভুক্ত করা উচিত, তার ফাঁক বিশ্লেষণ করা হয়তো প্রয়োজন। তার জন্যই এই লেখাটি তৈরি। ইংরিজিতে এই ধরণের প্রচেষ্টাকে কেউ কেউ Gap Analysis বলেন। তারই সরাসরি অনুবাদ করে আমি ফাঁক বিশ্লেষণ কথাটি ব্যবহার করি এখানে।
রাজ্যপালের সুপারিশ তালিকা ধরেই বিশ্লেষণ শুরু করছি।
পরিবেশ
১. বিশ্বভারতী সংরক্ষণ সমিতি গঠন করা, যাতে উপাচার্য নেতৃত্ব দেবেন এবং যাতে SSDA’র প্রতিনিধিরা থাকবেন। তাতে উপাচার্যর নেতৃত্য থাকা উচিত। এই সমিতির কাজ হবে বিশ্বভারতীর জমির মালিকানা বিষয়ক সব কাগজপত্র দেখা এবং বিশ্বভারতীর প্রাপ্য জমির সীমানির্দেশ করা।
এই কাজ কতদূর এগিয়েছে জানা নেই। বর্তমানে SSDA জীবিত না মৃত তাও জানা নেই। এই রিপোর্ট লেখা হয় যখন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় SSDA’এর নেতা ছিলেন। বিষয় টা গুরুত্বপূর্ণ, এবং এর সমাধান নিয়ে মতানৈক্য আছে। আজ যে বিশ্বভারতীর চারিদিকে দেয়াল উঠানো হয়েছে তা নাকি HLC রিপোর্ট অনুযায়ী। অথচ রিপোর্টে দেয়াল তোলার উল্লেখ নেই। শুধু তাই নয়, প্রাচীরবেষ্টিত বিশ্বভারতী এবং রবীন্দ্রনাথের চিন্তা পরস্পরবিরোধী। বিশ্বভারতীর জমির সীমিকরণ ও রক্ষা এরকম চরম চক্ষুশূল বিশ্রী শহুরে কদর্যতা ছাড়াই সৌন্দর্যবোধবিশিষ্ট প্রকারে মুক্ত দিগন্তকে অবরুদ্ধ না করেই করা যেত এবং তাই করা উচিত ছিল। মনে হয় রিপোর্টকে অপব্যবহার করা, বা তার থেকে অন্যায় সুবিধা গ্রহণ করার কামনা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান।
২. উত্তরায়নকে ঐতিহ্যময় ঘোষণা করা হোক এবং সাংস্কৃতিক মন্ত্রীত্যের অধীনে আনা হোক।
মনে হয় এটা হয়ে গেছে। তাতে বাড়িগুলির রক্ষণাবেক্ষণ হয়তো ভাল করে হবে। বাকি কি উন্নতি হয় তা দেখার ইচ্ছে রইল।
৩. হাইকোর্ট বা সুপ্রীমকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত এক বিচারপতিকে নিয়োগ করা উচিত বিশ্বভারতীর জমি যদি বেআইনীভাবে যদি চুরি বা বাজেয়াপ্ত করা হয়ে থাকে, তা দেখতে ও প্রতিকারে রপ্ত হতে।
এই কাজটি করা হয়েছে কিনা জানি না। কেউ কি বলতে পারেন ?
৪. এক আন্তর্জাতিক মানের বাসস্থান তৈরি করা হোক আমন্ত্রিত বিদ্বান ও পণ্ডিতদের জন্য।
এই যুক্তিটা পুরোপুরি মানতে পারলাম না। যেই বিখ্যাত গবেষকরা পেরু বা সাইবেরিয়া কি সাহারাতে গিয়ে ভাল কাজ করতে যান, তাঁরা কখনই ওখানে গিয়ে ওয়াল্ডর্ফ অ্যাস্টোরিয়া বা তার মত পাঁচ তারকার (five star) হোটেল আসা করবে না। যা আসা করবেন তা বিশ্বভারতীতে বস্তুগত ভাবে আছে, হয়তো ছোটখাটো উন্নতি দরকার তাতে। যেখানে গন্ডগোল এবং ভীষণ ভাবে যা লক্ষিত হয়েছে, তা হল অমানুষিক অবহেলা, অতিথি অবমাননা, এবং অতিথিযালার পরিচ্ছন্নতা, শুচিতা রক্ষার প্রতি চুড়ান্ত অমনযোগিতা। বিশ্বভারতী কি করে অতিথি সেবা করতে হয়, কি করে আগন্তুকদের বরণ করতে হয়, সাদর অভ্যর্থনা করতে হয়, কিকরে তাদের থাকাকে আনন্দদায়ক মনোরম করতে হয় - তা ভুলে গেছে। যারা অতিথিশালায় চাকরি করে তারা মাইনে নেয় নিশ্চই, কিন্তু অতিথি আপ্পায়ন কি বস্তু তা জানেই না। তারা ঘরগুলিকে পরিস্কার ছিমছাম রাখা তো দূরের কথা, জঘন্য অবস্থাশ রাখে। ঘরে ঝুল আর মাকড়সার জাল, বিছানার চাদর ছয় মাসে পাল্টানো হয়নি, তাতে ছোপ ছোপ দাগ। ঘরে গন্ধ। চানের ঘর তকতকে পরিস্কার নয়। দরজা জানলা ভাল করে বন্ধ হয়না, খোলে না। Internet’এর ব্যবস্থা নেই কিম্বা থাকলেও তার তত্বাবধানের কাজ যাদের তাদের দরকারে পাওয়া যায়না। সারা বাসস্থানে একটা নিদারুন অবহেলা ও অবক্ষয়ের ছাপ। রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা খুবই খারাপ, কারও মাথা ব্যাথা নেই রোজ দেখে যাওয়ার, গাফিলতি ঠিক করার বা কারোর ভুল শোধরাবার। বিশ্বভারতীকে আন্তর্জাতিক বাসস্থান দেবার কোনও দরকার নেই এখন। দরকার তার নানা রকম গেস্ট হাউসগুলির সব রকম উন্নতি করা, তাদের মার্জিত করা, ছিমছাম পরিষ্কার করা এবং অতিথিদের সুবিধা অসুবিধার দিকে এখনের চেয়ে একশো গুন বেশি নজর দিতে শেখা। বিশ্বভারতীর ঘাটতি টি hardware’এ নয়, software’এ।
সত্য কথা বলতে গেলে - সারা বিশ্ববিদ্যালয়ে software’এ গোলমাল - virus infected।
সত্য কথা বলতে গেলে - সারা বিশ্ববিদ্যালয়ে software’এ গোলমাল - virus infected।
৫. বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগগুলিতে নিজ নিজ সংরক্ষণের জন্য বিশেষ কর্মচারী নিযুক্ত করা হবে এবং তাদের পর্যাপ্ত পরিকাঠানো ও সাহায্য দেওয়া হবে যারা বর্জিতাংশ ও জঞ্জাল বিনস্ত করবে প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে।
এখানেও আমি মনে প্রাণে এই সুপারিশকে মানতে পারলাম না। বিশ্বভারতীর লোকেরা গোপাল গান্ধিকে তাঁদের মত জানিয়েছে এবং তার মধ্যে দেখতে পাই লোকেদের চিরাচরিত চাহিদা - আরও দাও, আরও দাও। যেহেতু অবর্জনা দূর করা হচ্ছেনা ঠিক করে, সুতরাং সব বিভাগে অরও পাঁচটা করে লোক রাখা হোক যারা আবর্জনা কি করে দূর করা যায় দেখবে। এটা হল শুধু আরও লোকের চাকরি বাড়ানোর ধান্ধা, সরকারের কাছ থেকে কিছু কাজ না করে আরও আদায় করার ফন্দি, কাজ সমাধান করার নয়। অবর্জনা দূর করা, প্রকৃতিকে রক্ষা ও পালন করা সবার সন্মিলিত কাজ হওয়া উচিত, এবং এটা তাদের শিক্ষার অন্যতম প্রধান অঙ্গ হওয়া দরকার। এর মধে্য আবার বাঙালি মধ্যবিত্ত মনবৃত্তি দেখা যায় - নিজে কিছু কাজের হাত লাগাবো না - দরকার হলে আরও চাকর বাকর রাখা হোক - তারা কাজ করবে। এক কথায়, বিভাগ গুলির উচিত তারা আবর্জনা দূরিকরণও করবে এবং আরও লোক না নিয়েই করবে। এমনিতেই ওখানে চাকুরেরা গিজগিজ করছে কাজ না করেই।
৬. বৈদ্যশালা এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার সর্বাঙ্গিক উন্নতিসাধন দরকার।
এই সুপারিশ গুলি দেখলে হাসিও পায়, কষ্টও হয়। সব কিছুই সরকারের কাছে দাবি, অথচ স্থানীয় লোকেরা কিছুই করবে না, শুধু সরকারী টাকার অপচয় করবে। চিকিৎসালয়ের এমন দূরবস্থা কেন ? টাকার অভাবে না ফাঁকিবাজ সরকারি টাকা অপচয় করার লোকের প্রাধান্য হেতু ? হাসপাতালের উন্নতি না করতে পারলে ওখানের কর্মচারিদের ইস্তফা দিয়ে এমন লোকদের রাখা হোক যারা কাজ করতে জানে।
বিদ্যালয় সংক্রান্ত
৭. বিশ্বভারতীকে এমন সাহায্য করা দরকার যাতে কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের সুবিধা বা সুযোগ সে পায়। কিন্তু একই সঙ্গে একে রক্ষা করা প্রয়োজন গতানুগতিকতা, আঞ্চলিকতা, এত্যাদি থেকে, এবং পণ্ডিত নেহরুর চিন্তানুযায়ী বিশ্বভারতীর নিত্যনৈমিত্তিক ও ধারাবাহিক ক্ষয় থেকে।
বিশ্বভারতীর সাহায্যার্থে এখন দরকার downsizing, এবং অকাজের লোকদের সরানোর। এটাই প্রধান কাজ।
৮ ছাত্র ভরতি করার পদ্ধতিকে স্বচ্ছ করতে হবে।
এ বিষয়ে যা শুনেছি তা হল নিজেদের লোকেদের ঢোকানো হয় কোনো কোনো ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও অন্যান্য বিছার এড়িয়ে। এটা বন্ধ করার জন্য বলিষ্ঠ পদ নেওয়া প্রয়োজন।
৯ আসেপাসে আরও কেন্দ্রীয় ও নবদয় বিদ্যালয় খোলা দরকার স্থানীয় ছেলেদের জন্য যারা বাড়িতে থেকে আবাসিক ছাত্র হিসেবে শিক্ষালাভ করতে ইচ্ছুক। একই ভাবে রাজ্য সরকারের প্রয়োজন এই অঞ্চলে রাজ্য সরকার চালিত কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষায়তনের জাল প্রসারিত করা স্থানীয় চাহিদা মেটাতে। এই দুই প্রথাতে বিশ্বভারতী নিজ পাঠশালা ও মহাবিদ্যালয়ের সংখ্যার নিয়ন্ত্রণের অসাধ্য বৃদ্ধি থেকে রক্ষা পাবে এবং একই সঙ্গে স্থানীয় নাগরিকদের শিক্ষালাভের অধিকারও পূরণ হবে।
এই কাজ খুব দরকার এবং তাড়াতাড়ি দরকার - এই নিয়ে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারকে আবেদন করা উচিত।
১০ বর্তমান অনার্স ও মাস্টার্স মাত্রার শিক্ষাব্যবস্থা ছাড়াও, পাঁচ বছরের সংহত পাঠব্য্বস্থা ও বিষয়ের পরিকল্পনা করা দরকার। বিশ্ব-ভারতীর আরও নতুন বিষয়ে দক্ষ অধ্যাপক ও পণ্ডিতদের আনা উচিত যারা নতুন কাঠামো শিক্ষার কাঠামে তৈরি করবে শান্তিনিকেতনে।
এই বিষয়ে কিছু বলার নেই।
শ্রীনিকেতন
১১. শ্রীনিকেতন যেন আসেপাসের গ্রামাঞ্চলের মানুষদের সঙ্গে উদ্ভাবক ও প্রগতিশীল আদান-প্রদানের এক যথার্থ মাধ্যম হয়, এবং সেই মাধ্যম অনুযায়ী শ্রীনিকেতন পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলির উন্নয়ন ও অগ্রগতির সহায়ক হয়।
এই বিষয়ে এত কম লেখা হয়েছে, যেন অনুচিন্তনের প্রতীক - নেহাতই লিখতে হবে তাই লেখা। শ্রীনিকেতনের কার্যকলাপ বিশ্বভারতী স্থাপনের এক প্রধান কারণ। তার সঙ্গে বাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকেদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকা ছিল রবীন্দ্রনাথের অভিপ্রায় এবং তার পেছনে এক বৃহত সামাজিক কারণ আছে, আছে ছাত্রদের চরিত্রগঠনমূলক অভিপ্রায়। শ্রীনিকেতনের উন্নয়নের আবশ্যকতার সঙ্গে বিশ্বভারতীর কর্তব্য ওতপ্রত ভাবে জড়িত, এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চলের উন্নয়নের সঙ্গে শ্রীনিকেতনের কর্তব্য তেমনিই ওতপ্রত ভাবে জড়িত।
১২. শ্রীনিকেতনের কৃষিবিদ্যালয় যেন কৃষি শাস্ত্রে দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষানুষ্ঠানগুলির অন্্যতম হয়।
এই সুপারিশ কি wish list না উপদেশ, না সরকারের কাছে আবেদন, না নিজেদের কাজ করা হয়নি তার স্বীকৃতি? কৃষিশাত্রে বা যে কোনো বিষয়ে শিক্ষার মান কতটা উঁচুতে উঠবে, না নিচুতে থাকবে, তার দায়িত্ব বিশ্বভারতীর হওয়া উচিত, সরকারের নয়। কৃষি বিদ্যার মান - অন্যান্য সব বিদ্যার মতই, নির্ভর করবে তাঁর শিক্ষক ও প্রশাসকদের চেষ্টা, নিষ্ঠা, গবেষণার ওপর। এমন যেন না হয় যে এই সুপারিশের তালিকা ব্যবহার করা হোক এমন ভাবে যে বিশ্বভারতীর উন্নতি নামে শুধু সরকারের কাছে দাবিই থাকবে, কিন্তু লোকেদের নিষ্ঠা ও কাজের দায়িত্বর উল্লেখ থাকবে না।
প্রশাসন ও আর্থিক শৃঙ্খলা
১৩. বিশ্বভারতী কার্যক্রমে আবৃত্ত আয়ব্যয়ককের শতকরা কুড়ি ভাগ অর্থ ব্যয় করার চেষ্টা করবে বিশ্বভারতী উন্নয়নতালিকার কাঝ এগোতে।
একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন - শতকরা কুড়ি ভাগ না দশ ভাগ খরচ করা হবে উন্নতিকরণের পেছনে তার ওপর অধিক গুরুত্ব না দিয়ে দেওয়া উচিত অর্থ যেন অপচয় না করা হয়, চুরি না করা হয়, এবং উন্নতির নামে বিকৃত যুক্তি দেখিয়ে ভুল কাজে বা ভুল ভাবে অর্থের অপচয় না হয়।
১৪. একটি নতুন পোস্ট, Pro-Vice Chancellor’এর তৈরি করে উপযুক্ত ব্যক্তিকে ভার দেওয়া হোক।
এটা করা হয়ে গেছে।
১৫. Proctor’এর দপ্তর আবার সক্রিয় করা উচিত।
এই ব্যাপারে আমার কিছু জানা নেই, বক্তব্যও নেই।
-------------------------------------------------------------
এরই সঙ্গে হয়তো দরকার বিশ্বভারতীর মূল কর্তব্যগুলি পরিষ্কার ভাবে হেঁয়ালি ছাড়া লেখা যায় কিনা তার চেষ্টা করতে। লীনাদির মনে হয় ভারতবর্ষের সাংবিধানিক intellectual property rights’এর ওপর যে সুন্দর ধারা আছে, যা লীনা দির মনে হয় হয়তো পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠের অন্যতম। যদি তা ব্যবহার করা যায় তবে হয়তো সেই ব্যবস্থা অনুযায়ী বিশ্ব-ভারতীর জীবন্ত dynamic সৃষ্টি বিশ্ব-ভারতী শিক্ষানুষ্ঠানও তাঁর intellectual property’র মধ্যে পড়ে। এই বিষয়ে খুঁতিয়ে দেখার সময় এসেছে। সেই property right আজ exercise করা যায় কিনা দেখা দরকার। লীনা দির ধারনা যায়।
বিশ্বভারতী act ১৯৫১ সালের এবং তার ১০৬০, ১৯৭১ ও ১৯৮৪’এর amendment’ও দেখা হয়েছে। চিন্তা করা হ’ল কি করা যায় এখানে, নাগরিক হিসেবে বা প্রাক্তনী হিসেবে। এই act’কে সংশোধন করা, বা বাতিল করা, বা এতে আরও কিছু দফা যুক্ত করা। নতুন দফা যদি যুক্ত করতে হয়, তবে তার পাঠ বা লিপি কি হবে, কে লিখবে?
ভাবলাম আমাদেরই উচিত এটা লেখা এবং সরকারের দৃষ্ঠি আকর্ষণ করা। শুধু বসে বসে অন্য লোককে নিন্দা না করে, নিজের ক্ষমতা ও বিচার অনুযায়ী, নিঃস্বার্থ ভাবে, যা সম্ভব তাই করা।
কিন্তু, ওপরের পনের টা সুপারিশ বার বার পড়ে, এবং চিন্তা করে, মনের মধ্যে একটা খটকা লাগছে - এই তালিকাটি সম্পূর্ণ নয় বলে। এই তালিকাতে যা আছে এবং যেমন ভাবে তা স্ফুরিত বা ব্যক্ত, তাতে মনে হয় অনেক দরকারি যুক্তি না বলা থেকে গেছে।
সুতরাং, HLC রিপোর্টের সুপারিশ তালিকার ওপর আমার মন্তব্য ছাড়াও, কতগুলি অত্যাবশ্যক যুক্তি ও বিচারও আলাদা করে লেখা প্রয়োজন মনে করি, এবং সেটা এই ব্লগের শেষে লিখবো আসচে দিন কয়েকের মধ্যে।
শুরুতেই যা লেখা দরকার তা হ’ল, বিশ্বভারতীর মূল লক্ষ ও উদ্দেশ্যর সংক্ষিপ্ত তালিকা। বিশ্বভারতী কেন করা হয়েছিল এবং তার মূল কর্তব্য কি - সেটা মনে হয় অনেকের মনেই হেঁয়ালি আছে। আমি আমার বুদ্ধি অনুযায়ী বিশ্বভারতীর কর্মতালিকাতে তিনটি পদ লিখেছিলাম। তান লী দা তাতে একটি আরও যোগ করেন, চার নম্বর।
সেগুলো এবং তারই সঙ্গে আমাদের সুপারিশ, বিশ্বভারতী ও রবীন্দ্রশিক্ষা চিন্তা রক্ষা করার ও তার প্রয়োজনীয়তা নিয়েও লিখবো এখানে - একে একে।
আপনাদের বক্তব্য শোনার ইচ্ছে রইল। লিখতে অনুরোধ জানাচ্ছি এই ব্লগের তলায়। আমায় যদি email করতে চান - tonu@me.com
এবার HLC রিপোর্ট ছেড়ে - লিখছি বিশ্বভারতীর পরিচয়, এবং কর্তব্য কি হওয়া উচিত, সে বিষযে আমার মত।
বিশ্বভারতীর পরিচয়
বিশ্বভারতী এমন একটি শিক্ষাকেন্দ্র যেখানে ছাত্র, শিক্ষক, বাসিন্দা ও পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চলের লোকেরা একে অন্যের জীবন সম্পর্কে সচেতন ও তাদের সুখদুঃখের অংশীদার হবেন, এবং সন্মিলিত ভাবে সমাজকে অগ্রসর করার দায়িত্ব শিখবেন, এবং তারই সঙ্গে নিজেদের পেশা, জীবিকা, কারুশিল্প, শিক্ষার উন্নতিসাধনে রত হবে।
বিশ্বভারতীর কর্তব্য
- এক - বিশ্বভারতী দেশের সবধারার সংস্কৃতিকে গবেষণা করে জাতির গূঢ জীবনীশ্রোতকে জানার ব্যবস্থা করবে। তার জন্য বৈদিক, পৌরানিক, বৌদ্ধ, জৈন, মুসলমান প্রভৃতি ধর্মচিন্তা এবং তার সঙ্গে আদিবাসী জীবনচিন্তা গবেষণা করে তাদের সমস্ত সত্বার সন্মিলনে সারা ভারতবর্ষের প্রাণের ধারা কোন দিকে প্রবাহিত হচ্ছে তা জানবে, এবং সেই ভাবে নানা বিভাগ ও বৈচিত্রের মধ্যে দেশের ও সমাজের সমগ্রতা উপলব্ধি করায় ব্রত হবে - সেই শিক্ষায় বিশ্বভারতীর ছাত্ররা দেশকে সম্পূর্ণরুপে জানতে, বুঝতে শিখবে এবং সেই সমাজবিজ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিতে অন্যান্য অর্জিত বিদ্যা কিভাবে দেশ ও সমাজের উন্নতির জন্য প্রয়োগ করা যায় যাথাযত ভাবতে পারবে।
- দুই - নতুন বিদ্যা উৎপাদন হবে বিশ্বভারতীর মুখ্য বা প্রধান কর্তব্য। সে শিক্ষা দান করা বা হবে দ্বিতীয় পর্য়ায়ভুক্ত, বা গৌন, কর্তব্য। বিশ্বভারতী তেমন মনীষীদের আকর্ষণ করবে, আহ্বান করবে, যারা নিজেদের সাধনা, প্রভা দ্বারা নতুন বিদ্যার অনুসন্ধান ও আবিষ্কারের কাজে নিযুক্ত ও নিবিষ্ট আছেন। এরকম মনীষীদের বিশ্বভারতীতে একত্র করে এমন পরিবেশ গঠন করা হবে যা স্বভাবতই নতুন জ্ঞানের উৎস হবে এবং তার দ্বারা প্রভাবিত বিশ্ববিদ্যালয় শেখা বিদ্যার ওপর নব্য দর্শন, আবিষ্কার ও চেতনাকে সংযুক্ত করে দেশের জ্ঞানভাণ্ডারকে ক্রমাগত সমৃদ্ধ করবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে নতুন দিগন্তের নতুন যুগের উপযোগী নতুন শাস্ত্র তৈরির কাজে সর্বদা নিযুক্ত রাখবে। এরই পরের বৃহত ধাপ হ’ল শুধু দেশেরই নয়, সারা প্রাচ্যের ও প্রাশ্চাতে্যর, তথা সমগ্র পৃথিবীর মানবচেতনার মূল উৎস সন্ধানের গবেষণায় রত হবে, ঠিক ঠিক মনীষীদের আকর্ষণ করার চেষ্টায় বিশ্বভারতী ব্রত থাকবে এবং এমন পরিবেশের সৃষ্টি ও রক্ষণ করবে যাতে আশ্রম যেন এক জগতব্যাপ্ত চুম্বকের ন্যায় সমস্ত পৃথিবীর নববিদ্যাসৃষ্টির অন্যতম কেন্দ্র ও তীর্থস্থান হয়।
- তিন - বিশ্বভারতীতে গঠিত ও বণ্টিত বিদ্যা এমন যেন না হয় যে তা বিদেশে অর্জিত বিদ্যার বিকৃত অনুলিপি মাত্র এবং শুধুই মধ্যবিত্ত সমাজের কেরানিগিরির উপযোগী মুখস্ত শিক্ষা। এই বিদ্যালয়ে আবিষ্কৃত বিদ্যা এমন হবে যা সরাসরি আসেপাশের গ্রামাঞ্চলের লোকেদের ও প্রকৃতির মান উন্নয়নের সহায় হবে। এইরুপ বিদ্যা আবিষ্কার হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম মুখ্য কর্তব্য। এরই সঙ্গে, মধ্যবিত্ত ও উচ্চ শ্রেনীর ভদ্রলোক ও ধনীদের ভেতর যে নিচু জাতির বা গরিব ও দুর্বল জাতিদের প্রতি ঘোর অবজ্ঞা আছে, তা মন থেকে ও জীবন থেকে দূরীকরণ হবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম লক্ষ, এবং এই প্রতিষ্ঠানের সবাই যেন নিজেদের জীবনের উদাহরণ স্বরুপ বহির্জগতের লোকেদের প্রভাবিত করাবে। এই বিদ্যালাভে ছাত্ররা যেন দেশকে ভালবাসতে শেখে এবং দেশের মঙ্গলে কাজে নামতে শেখে। দেশ থেকে দলে দলে পালিয়ে অন্যরাজে্য আশ্রয়ার্থী হয়ে দিন কাটানোর প্রচেষ্টাই যেন এই শিক্ষার মূল প্রযোজ্য পরিনাম না হয়।
- নাচ, গান, চিত্রকলা ও এইপ্রকার নানান সৃজনীশক্তি প্রকাশের রাস্তা খোলা রাখা বিদ্যালয়ের অন্যতম কর্তব্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূুল কর্তব্যগুলির বিকাশ ও সাধন উপলক্ষে নানান সাংসকৃতিক অনুষ্ঠান স্থাপন করা হয়েছে - তাকে বজায় রাখতে এই গান, নাচ, চিত্রকলার উতকৃষ্ট ব্যাবহার করা হবে - এবং এই অনুষ্ঠানগুলিকে শুধুমাত্র প্রমোদানুষ্ঠান হিসেবে অভিব্যক্ত না করে, সমাজে তার প্রয়োজনীয়তা কি, তার উপলব্ধি ও প্রচার হবে অন্যতম মূুল লক্ষ। এই জন্য এই সব অনুষ্ঠানে সারা বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশগ্রহণের প্রয়োজন। শ্রীনিকেতনের অনুষ্ঠান যদি শুধু শ্রীনিকেতনের লোকেরাই করে এবং বাকিরা যদি তা দেখতেও না যায়, বা তাতে অংশগ্রহণে আগ্রহ প্রকাশ না করে - যদি সেটা নেহাতই একটি ছুটির দিন মাত্র হয়, বা বড়জোর কয়েক ঘণ্টার নাচ গানের জলসা হিসেভে ধরা হয়, যা সহরের মঞ্চের বদলে গ্রামের মুক্তাঙ্গনে পেশ করা হচ্ছে - তাহলে সে অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। নৃত্য, গীত, চিত্রকলা যে শুধু শেখানোই হবে তা নয় - এই কলাশাস্ত্র আঠা স্বরুপ সারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্র, শিক্ষক কর্মচারি, সব বিভাগকে একত্র রাখবে ও একে অন্যের কাজে সহায়তা করতে শেখাবে।
এই ভাবে বিশ্বভারতীর আদর্শ রক্ষা করা যায়, এবং এই ছোট তালিকা বিশ্বভারতীর সংক্ষিপ্ত পথনির্দেশক সূত্র হতে পারে
লিখেছিনু রামহনু নামতনু