Search This Blog

Sunday, July 17, 2011

আমার দাদুকে নিয়ে


সোমবার, ১৩ই জুন, ২০১১

কাল সন্ধ্যাবেলা তান লীদদের বাড়ি বসে ওনার power point presentation’টার কাজ এগিয়ে দিচ্ছি, অার তার সঙ্গে লীনাদির সঙ্গে অাড্ডাও চলছিল। “একটি কাহিনীর কাহিনী” বলে যে বাংলা ও ইংরেজি মেশানো ছোট লেখাটা blog’এ তুলেছি, ভুলটুল সুদ্ধ, সেটা ওঁদের খুব পছন্দ। প্রশ্ন উঠলো internet’এ কি কি লেখা যায়, এবং অাগের তুলনায় কত লোকে অাজ অাসল কাগজের দৈনিক বা সাপ্তাহিক পড়ে, অার কত লোক web’এ পড়ে - এই সব।

তান লী দা যে শান্তিনিকেতনের স্নাতকদের মধ্যে একরকম অনন্য, বা তুলনাহীন, এবং কেন সেটা তাৎপর্যপুর্ণ ও  গুরুদেবের চেষ্টার ফলস্বরুপ - এই সব কথা যখন চলছে, তান লী দা চুপচাপ শুনছিলেন এবং তাঁর বাবার ফোটো নাড়াচাড়া করছিলেন। হঠাৎ অামার দিকে তাকিয়ে মনে করিয়ে দিলেন যে, শান্তিনিকেতনের সার্বাঙ্গিক বিকাশের কর্মে অামার দাদু কালীমোহন ঘোষের অবদান কিছু কম নয় - যদিও বেশির ভাগ লোকই তা জানে না। কালীমোহনকে শান্তিনিকেতনে বেশি দেখা যেত না - তিনি শ্রীনিকেতনে এবং গ্রামে গঞ্জে কাজে ব্যস্ত থাকতেন। তান লী দা দের মত প্রাক্তন ছাত্ররাও তাঁকে খুব কম দেখেছে - হলকর্ষণ, এবং শ্রীনিকেতন মেলা ছাড়া।

কালীমোহন শুধু যে রবীন্দ্রনাথের সমাজ ও পল্লী উন্যয়ন চিন্তাকে রুপান্তরিত করার কাজে যুক্ত ছিলেন তাই নয়, বিভাজিত ও দ্বন্দ্বরত গোষ্ঠী ও উপজাতিতে ভাঙা ভারতীয় সমাজের ভেদাভেদ দূরীকরণের প্রশংসাহীন দুঃসাধ্য কর্মযোজ্ঞে তিনি রবীন্দ্রনাথের সর্ব প্রথম ও একমাত্র মনেপ্রানে অনুগামী কর্মী ছিলেন। ওনার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যোগ শান্তিনিকেতনেরও অাগে, বাংলাদেশে গ্রামোন্যয়ন-চেষ্টার সময় থেকে।

লীনাদির মনে হ’ল ইচ্ছা অাছে অামার সঙ্গে কিছুটা হাত মিলিয়ে একটা লেখার বা গবেষণার ক্ষেত্র তৈরি করতে - শান্তিনিকেতনে কালীমোহন ঘোষের অবদান, এবং তারই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পল্লী সংগঠন চিন্তার নতুন বিশ্লেষণ এবং অাজকের নতুন শতাব্দির সভ্যতার সীমা-অতিক্রম করা জড়বাদী ভোগ, প্রাকৃতিক অবনতি, পার্থিব সম্পদের অতি ব্যবহার সম্পর্কিত  মহাসংকটের পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের শতবর্শ অাগের পল্লী উন্নয়ন চেষ্টার চিরন্তন প্রাসঙ্গিকতা - এই সব বিষয় নিয়ে। উনি পিয়ালির সঙ্গেও কথা বলতে চান - যে সব পুঁথি কালীমোহন ঘোষ সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছিলেন অাসপাসের গ্রাম থেকে, ঝুড়ি করে, কত বছর অাগে, তার সম্বন্ধে অারও কিছু জানার।

কি করব ভাবছি - তান লী দা বলছে, অামি না করলে অার কেউ হয়তো নেই অামার বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অামার পরিপ্রেক্ষিতে কালীমেহন সম্বন্ধে লেখার। অামি অধ্যয়ন বিষয়ক পণ্ডিত না হলেও, অামার নাকি লেখার একটা স্বাভাবিক দক্ষতা অাছে, এবং অাছে এই বিষয়ে গভীর অাগ্রহ এবং অামার মা ও দাদুর থেকে পাওয়া gene।      সুতরাং অামার উচিত চাকরি বাকরির মধ্যেই এ কাজ শুরু করা, একটু একটু করে।

অামার মা, সুজাতা মিত্র, লেখিকা ছিলেন না। কিন্তু তিনিও শেষ পর্যন্ত শ্রেয়শী পত্রিকাতে লিখেছিলেন তাঁর পিতা কালীমোহন কে নিয়ে - পারিবারিক ঢাক পেটানোর চেয়ে সব ভুলে যাবার অাগে সত্যপ্রকাশের কালোপযোগী কর্তব্যবোধই তার সংগত কারণ ছিল - তিনি অামাকে বলেছিলেন। তা ছাড়া, কালীমোহন সম্পর্কে লেবু দার (পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়) বইটি অামি পড়েছি এবং এল্মহার্স্ট’এর লেখাটিও। এ ছাড়া, অামি রবীনদ্রনাথের লেখা প্রবন্ধ, চিঠি এবং বক্তৃতা পড়েছি এবং প্রায়ই পড়ি। রবীন্দনাথের ওপর লেখা বই অনেক অানিয়ে পড়েছি - রানী চন্দ বা বড়মামা শান্তিদেব ঘোষ থেকে নিয়ে অমিয় চক্রবর্তী, এল্মহার্সট, রথেনস্টাইনের চিঠি পত্র, এডওয়ার্ড থমসন, প্রসান্ত চন্দ্র মহালানবিশ, কৃষ্ণ কৃপালিনী, ষ্টিফেন হে,  মেরি লাগো, চার্ল্স এন্ডরুস, হুমায়ুন কবির, নেহরু, রবিনসন ও কৃষ্ণা দত্ত, উমা দাসগুপ্তা, রামচন্দ্র গুহ, ক্যাথলিন ও’কোনেল প্রমুখদের। একেক জন রবীন্দ্রনাথকে একেক ভাবে দেখেছেন, বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু রবীনদ্রনাথের সমাজচিন্তা ও গ্রামোন্নয়ন চিন্তা মনে হয় বেশির ভাগ পণ্ডিতেরই তত্ত্বানুসন্ধানগণ্ডির বাইরে ছিল, বা কোনও কারণে তাঁরা এ বিষয়ে অনবহিত বা অনাগ্রহী ছিলেন। অামার অনেক সময় মনে হয়েছে যে, রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্তিফলে, নতুন দেশি ও বিদেশি রবীন্দ্রানুরাগীরা হয়তো রবীন্দ্রসঙ্গীত, ও তাঁর কবিতার ও লেখার ওপর বিশেষ প্রাধান্য দেন এবং মনোনিবেশ করেন। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের পল্লী, সমাজ ও প্রাকৃতিক সংরক্ষণ ও সংস্করণের  গুরুত্বপূর্ণ, তাৎপর্যময় এবং তখনকার ভারতবর্ষ ও পৃথিবীতে একরকম তুলনাহীন প্রচেষ্টা এই রবীন্দ্রবিশ্লেষকদের কাছে একরকম অলক্ষ, দর্শনাতীত ধাঁধা হয়ে রইল। এটা অামাদের একটা বৃহৎ ক্ষতি ও দুঃখজনক ঘটনা বলে অামার বিশ্বাস। সেই দিক দিয়ে দেখতে গেলে, কালীমোহনের কর্মক্ষেত্র এবং তিনি কতখানি ও কি ভাবে রবীন্দ্রনাথ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন তার নতুন  তথ্যানুসন্ধানের কাজ রবীন্দ্রনাথের এই জুগান্তকারী বাস্তবচিন্তা ও উপেক্ষিতা পল্লীপ্রকৃতির সঞ্জীবন ও সংরক্ষণের ওপর নতুন করে অালোকপাত করবে বলে মনে করি। এই কাজে অনুশীলনের প্রয়োজন অাছে বুঝি। সে কাজের জন্য কি তনু উপযুক্ত কিনা, সেটাই প্রশ্ন।

লেখা অামার পেশা নয়, বিশেষ করে বাংলাতে এবং রবীন্দ্রবিষয়ক। তার ওপরে, কালীমেহন নিয়ে লিখতে গেলে হয়তো একটু নিজের ঢাক পেটানোর পর্জায়ে পড়ে যায়, কারন তিনি অামার দাদামশাই হন - মায়ের পিতা। অনেকে অাছেন যাঁরা শান্তিনিকেতন বিশ্লেষণ করেন, ইতিহাস ঘাঁটেন, বই পড়েন ও লেখেন। এঁদের হাতে এসব লেখা মানায়।

তবে, অাজ ওবধি কালীমোহনের ওপর যে সব লেখা অামার চোখে পড়েছে, তার মধ্যে সব চেয়ে ভাল লেগেছে অামার মা সুজাতা মিত্রর লেখাটি। তার কারণ এই নয় যে সুজাতা মিত্রই কালীমোহন সম্পর্কে শেষ কথা বলতে পারেন - বরং কালীমোহনকে নিয়ে যে অারও গবেষণার কাজ অবশিষ্ঠ অাছে, এ হয়তো তারই প্রতিফলন।

লীনা দি’র দৃষ্টিকোনে অাছে রবীন্দ্রনাথের “মহামানব” দর্শানুপাত নিয়ে অারও কাজ করা এবং এর উপাখ্যান অবাঙালির কাছে ও বহির্জগতে প্রচার করা। ওঁর মতে এই দর্শনভাব ও চিন্তাধারা, যা রবীন্দ্রনাথ হয়তো ভারত তথা সারা বিশ্বের মানব সভ্যতার একদিকের অগ্রগতি ও ক্রমবৃদ্ধি এবং অন্যদিকের অর্থগৃধ্নুতা, প্রচণ্ডতা ও অবক্ষয়ের রহস্য সমাধানপ্রশ্নের উত্তরস্বরুপ পেয়েছিলেন, তা বহুমূল্য, এবং অাজকের নতুন সহস্রাব্দে বিশেষ করে যুগোপযোগী বানী। লীনা দি বাংলার চেয়ে হিন্দি ও ইংরিজিতে পারদর্শিনী বেশি, এবং হয়তো বা ভাবছেন যে অামি বাংলাতে লিখি এবং উনি তার হিন্দির দিকটা দেখবেন। ইংরিজি তো সবাই জানে, এবং যে কেউ লিখতে পারে অামাদের মধ্যে।

ওদিকে তীর্থঙ্কর দা ও মন্দাকান্তা দি অনেকদিন থেকে অামাকে বলছেন কালীমোহন ঘোষ সম্বন্ধে লেখা শুরু করতে। কি করি, ভাবছি। তীর্থঙ্করদা তো এও বললেন যে কালীমোহনের সঙ্গে অার্নোল্ড বাকের যোতাযোগ ছিল কিনা, এবং ব্রিটিস লাইব্রেরি বা বিদ্যালয়ে এই বিষয় নিয়ে যোতাযোগ করা যায় কিনা, এই সব বিষয়ে অামাকে উৎসাহ দিয়ে তিনি একাধিকবার অামাকে বলেছেন ও লিখেছেন।

কালীমোহন একবার ডায়েরিতে লিখেছিলেন কেন এগারোই মাঘের ব্রাহ্মসমাজের কলকাতার মিটিংয়ে যাওয়া বন্ধ করলেন অনেক বছর উপস্থিতি জানিয়ে। ওখানে নিরাকার ব্রহ্ম বনাম পুত্তলিকা পূজার সুক্ষ চুলচেরা অনেক তর্ক বিতর্ক পেয়েছেন, কিন্তু মানুষকে খুঁজে পাননি। সেই মানুষের খোঁজে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করে কালীমোহন মাঘোৎসবের পথত্যাগ নাকি করেছিলেন এবং ডায়রিতে তার বিবৃতি দিয়ে গেছেন। এই মানবধর্মবোধরোপণ হয়তো অামার দাদামশাইয়ের মনে রবীন্দ্রনাথের অন্যতম প্রধান অবদান। মানবকল্যাণ প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে  মোক্ষ লাভই সর্বশ্রেষ্ঠ পথ - এই দীক্ষা তিনি রবীন্দ্রানাথের কাছে পান। রবীন্দ্রনাথ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতার অসহ, আক্রমণমূলক, রণলিপ্সু, মাত্রাধিক্য হিংস্রতা দেখে, সভ্যতার অগ্রগামীতা উপলক্ষে মোহমুক্ত হয়ে, বিষণ্ণহৃদয়ে তাঁর জীবনের সর্বশেষ অভিভাষণ সভ্যতার সংকটে তিনি যে গানটি পেশ করেন, “ঐ মহামানব অাসে” তা লঘুরসে রচনা করেননি। সভ্যতার ওপর ভরসা হারালেও মনুষ্যত্যের ওপর বিশ্বাস তাঁর শেষ দিন ওবধি অক্ষীণ ছিল। সেই মনুষ্যত্যের মন্ত্র তিনি শিখিয়েছিলেন কিশোর কালীমোহনকে, যে মন্ত্র কালীমোহনের জীবনে ধ্রুবনক্ষত্রস্বরুপ ছিল।

কালীমোহনের জীবনে লঘুরস অাস্বাদনের সুজোগ বেশি অাসেনি - অাসেনি গ্যালারির দিকে তাকানোর, বা মঞ্চে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞ লোকেদের সামনে সংস্কৃতি পেশ করার বা অধ্যাত্মবাদের চুল চেরা বিশ্লেষণ করার। গ্রামে গঞ্জে রাত বিরেতে, রোদে, জলে, কাদায়, ঘেমে, মশার কামড় খেয়ে, মানুষের সঙ্গে মানুষের বিভেদের মোকাবিলা করে, তাদের দৈনন্দিন সমস্যার দীর্ঘজীবি সমাধান খুঁজে, হিন্দু-মুসলমানের ভেদ ও বাঙালি-সাঁওতাল ও অন্যান্য জাতিভেদে মধ্যস্থতা করে, তাদের স্বাস্থ, চাষ, সমাজের বন্ধন ও নিষ্ঠুরতার মোকাবিলার পশ্চাদ্ধাবনে তাঁর দিন কাটতো। সময় পাননি শান্তিনিকেতনের বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে মেলামেশা করে সময় কাটানোর ফুরসত পান নি। তিনি  মানবধর্মের  বেদতুল্য মন্ত্র পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। তা নিয়ে লিখতে গেলে তেমন লেখক কই? লোকে বলে, একজনের সম্বন্ধে লিখতে বা বুঝতে গেলে - one would need to walk in his shoes first। কালীমোহনের ছেঁড়া জুতো পড়ে তাঁর মত বনে বাঁদড়ে ঘুরে ঘুরে স্থানীয় সথ্য সংগ্রহ এবং মৃতকল্প গ্রামগুলির উন্নতিসাধনের জন্য কাল কাটানোর মত লোক কি অার এই প্রজন্মে অাসবে, না এমন লোকদের প্রভাবিত করার জন্য অাবার গুরুদেব অাসবেন ফিরে?

লীনা দি অার তান লী দা বলছেন চেষ্টা করলে লিখতে পারবো।

জানি না।

No comments: