Search This Blog

Friday, July 29, 2011

KMG-7 ঃ কালীবাবুর কথা লিখতে গিয়ে আমাদের সামাজিক কর্তব্য নিয়ে দুটো কথা

২৭-জুলাই-২০১১

শান্তিনিকেতন তথা বাংলা পল্লীপ্রকৃতি, বা আরও বৃহত পরিমণ্ডল নিয়ে ভাবলে সারা পৃথিবীর এই প্রকাণ্ড কর্মক্ষেত্রে আমাদের নিজস্য নিজস্য জীবনে কিছু করণীয় আছে কিনা - তার শিক্ষা আমরা কতটুকু পেয়েছি এবং কিভাবে সেই শিক্ষা বহির্জগতে প্রয়োগ করেছি, এই প্রসঙ্গে কিছু লিখবো ভাবলাম। কালীমোহন ঘোষ সম্পর্কে অনেকেই বলছেন আবার করে গবেষণা করার সময় এসেছে। আমি গবেষক নই এবং কালী বাবুর সম্বন্ধে তথ্য যেসব স্থানে পাওয়া যায় আমি তার অনেক দূরে বাস করি। তবে, এই বিষয়ে আমার উৎসাহ জেগেছে ইদানিং। মনে হচ্ছে আমাদের নিজস্য দৃষ্টিকোনের চিন্তা এবং মতপ্রকাশেরও হয়তো স্থান আছে। তার বৃহত কারণ শুধু কালীমোহন ঘোষের জীবন বিশ্লেষণই নয়, রবীন্দ্রনাথের বিশ্বচিন্তা ও পল্লী উন্নয়নের প্রচেষ্টা তার সঙ্গে জড়িত। আরও জড়িত তার মধ্যে আমাদের কি করণীয় ছিল, তার সূত্র।

পিয়ালি মরিশাস থেকে ওর পল্লীপ্রকৃতি বইটির কপিতে ছাপানো ছবিগুলো আমাকে scan করে পাঠিয়েছে - শ্রীনিকেতনের পথে রবীন্দ্রনাতের সঙ্গে কালীমোহনের পেছন থেকে তোলা ছবিটি শুদ্ধ। ছবিটি আমার খুব পছন্দ, যদিও এর চেয়ে আরও পরিষ্কার ছবি থাকলে ভাল হ’ত। ছবিটিতে একটা করুণ রসের ইঙ্গিত পাই - যেন দুজনেই চললেন ছুটি নিয়ে, এবং তারই সঙ্গে শ্রীনিকেতন তথা ভবিষ্যৎ জগত আমাদের জিম্মায় দিয়ে গেলেন। তার ভালমন্দ তত্ত্বাবধান ভার এখন আমাদের ওপর।

মনে হল, রবীন্দ্রনাথ কি করেছেন, কত বিষয়ে সুদূরচিন্তা করে গেছেন, এবং নতুন প্রাচ্যের নবজাগরণের দূত হিসেবে তাঁর কতটা অবদান - এইসব নিয়ে তো পণ্ডিতরা অনেকটাই নস্য বাতাসে উড়িয়েছেন। তার সঙ্গে কালী বাবুর অবদান নিয়ে অনুসন্ধানের কাজও আজ জনপ্রিয় হচ্ছে। এ বিষয়ে আরও তথ্য বেরোবে। আমিও লিখবো সময়ে সময়ে এই আন্তর্জালের ব্লগের পৃষ্ঠায়।

আজকাল এই অান্তর্জাল অবলম্বন করে এমন একটা মাধ্যম তৈরি হচ্ছে ভবিষ্যৎ যুগের লেখক, ভাবুক ও চিন্তাশীল ব্যক্তিদের জন্য, যেখানে প্রকাশকের বা প্রচারকের বিশেষ দরকার রাখেনা। লেখার ভালমন্দ বিচার পাঠকরা করবেন, কিন্ত তাতে না থাকবে মুদ্রণ খরচা, না থাকবে পাঠকদের জন্য বই কেনার প্রয়োজন। বই লেখা ও বই পড়ার সঙ্গে যে একটা ব্যবসায়িক যোগ ছিল বই মুদ্রণের, প্রকাশনের, বিক্রির এবং তার জন্য পারদর্শী ব্যবসায়ীর, সেই যোগ ধীরে ধীরে ছিন্ন হতে চলেছে। আজ লেখা মুদ্রণের জন্য প্রকাশকের পেছনে ধাওয়া করার দরকার করেনা। অনেক যায়গায় লেখক বিনা পয়সায় লেখা বিলি না করলেও, মুদ্রণ এড়িয়ে সরাসরি পাঠক ক্রেতাদের ঘরে electronic বা audio বই পাঠিয়ে দিচ্ছেন কম্পুটার মারফত। এক কথায় কে লিখবে এবং কে পড়বে, তার হিসাব এখন চিরাচরিত প্রতিষ্ঠানগুলির হাত থেকে বেরিয়ে সাধারণ নাগরিকের হাতে পৌঁছে গেছে। পাঠকবৃন্দের রুপ পাল্টাচ্ছে, তার সঙ্গে পাল্টাচ্ছে লেখকদের মাপ ও মাত্রা, এবং খর্ব হচ্ছে মাঝখানে দাঁড়ানো দালালের প্রয়োজন। সুতরাং লেখকের যদি মনে হয় কিছু বক্তব্য আছে, এবং তা পড়ার জন্য যদি একটি পাঠকেরও উৎসাহ থাকে, তবে সেই প্রেরণাই যথেষ্ট হতে পারে কিছু লেখকের জন্য। তেমনিই, কিছু পাঠক হয়তো বা তেমনই লেখা পড়তে চান যার খরিদ্দের খুব বেশি নেই, কিন্তু তাহলেও তার সূক্ষ্ম বিচারে এমন লেখা যদি একজনও লিখতে পারে মাঝে মধ্যে, সে লেখার চাহিদা থাকবে পঠকের মনে। লেখক ও পাঠক হয়তো বা কখনো আলোচনায় নামবে মত বিনিময় করতে। নতুন যুগের নতুন এই মাধ্যম যে রবীন্দ্রচিন্তা এবং কালী বাবুর জীবনকে অবধি স্পর্শ করেছে - আমি আপনি তার প্রমান।

তবে এই মাধ্যম এখনও পরিনত হয়নি - পরীক্ষামূলক পর্যায়ে আছে এবং দিনে দিনে পাল্টাচ্ছে। তার ওপর, পাঁচ বছর আগের তুলনায় আজ বাংলা ভাষায় লেখা অনেক সোজা হয়ে গেছে, যদিও বানান ভুল, typo জাতীয় গোলমাল থেকে পরিত্রাণ আসতে হয়তো আরও দেরি আছে।

ইতিমধ্যে রবীন্দ্রনাথের পল্লীপ্রকৃতি বাঁচানোর চেষ্টা কতদূুর দরকার ছিল, বা কেন সে কাজ আজও শেষ হয়নি, এবং এখনও তার কেন প্রয়োজন, এর সঙ্গে কএটাও স্বীকার করা দরকার যে সে প্রচেষ্টা শান্তিনিকেতনে সফল হয়নি, হয়নি শ্রীনিকেতনেও। সে প্রচেষ্টা কেন বিফল হয়েছে, এবং তার জন্য কে বা কি দায়ী, এবং এই বিফলতা থেকে আমাদের কি শেখার আছে - একে কি আবার ঘুরিয়ে সফলতার দিকে নিয়ে যাবার সম্ভাব্যতা কিরকম, তার সময় ও প্রয়োজন অাছে কিনা - এই সব নিয়ে চিন্তা এবং আলোচনার সময় এসেছে।

গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পল্লীসমাজের সংগঠনকর্মে তার প্রয়োজনীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে লিখেছেন, সমাজগঠনে স্বার্থপরতার বদলে নিঃস্বার্থ কাজের উপযুক্ততার দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্শন করে, মৌমাছিদের মৌচাক বানানোর কাজের সঙ্গে তুলনা করে - নিজের জন্য কাজ করার চেয়ে সকলের জন্যে কাজ করাটা হয়ে উঠল বড়ো, সকলের প্রাণযাত্রার মধ্যেই নিজের প্রাণের সার্থকতা-বোধ জন্মাল— এরই থেকে বর্তমান কালকে ছাড়িয়ে অনাগত কালকে সত্য বলে উপলব্ধি করা সম্ভব হল; যে দান নিজের আয়ু-কালের মধ্যে নিজের কাছে পৌঁছবে না, সে দানেও কৃপণতা রইল না; লোকালয় বলতে এমন একটি আশ্রয় বোঝাল যেখানে নিজের সঙ্গে পরের, বর্তমানের সঙ্গে ভাবীকালের অবিচ্ছিন্ন সম্বন্ধ প্রসারিত।

পড়লাম আর মনে মনে হাসলাম। মৌমাছিরা সমাজচিন্তা না করেই, তাদের genetic code’এর তাড়নায় করে মৌচাক তৈরি। তাদের অস্তিত্ব এবং বেঁচে থাকা নির্ভর করছে তাদের মৌচাক বানানোর সফলতার ওপর, যদিও অত দীর্ঘপথের সমাধান প্রতিটি মৌমাছির স্বতন্ত্র চিন্তাশক্তির বাইরে। রবীন্দ্রনাথের আবেদনের লক্ষ্য এবং প্রাপক কিন্তু মৌমাছিদল নন - মানুষ, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজ। মৌমাছিদের উদাহরণ দিয়ে তিনি বাঙালি সমাজকে ডেকেছিলেন সবাই যাতে পল্লী উন্নয়নের জন্য হাত মিলিয়ে কাজে যোগ দিতে পারে। তাদের আহ্বান জানাচ্ছেন রবীনদ্রনাথ - শুধু আজকের নিজস্ব ভোগের পেছনে সব কর্মশক্তি ব্যয় না করে ভবিস্যতের মানুষের জন্যও সবার সঙ্গে মিলিত ভাবে কিছু সমষ্টিগত পূন্য কর্মে রত হতে।

এখন দেখা যাক, সে কথা আমরা কতটা শুনেছি। পাঠভবনের ও বিদ্যা-শিক্ষা ভবনের শিক্ষকদের কাছে আমরা এ বিষয়ে কি শিখেছি এ বিষয়ে? গুরুদেবের কৃয়াস্থল, পল্লী উন্নয়নের কারখানাতে বড় হয়ে এবং দিনে রাতে রবীন্দ্রনাথের নামতা আওড়েও আমরা নিজ গুনে কি আত্মভূত করতে পেরেছি এ বিষয়ে? সমাজের বৃহত কাজে যে ঁমাদের হাত মেলাবার একটা দরকার আছে, সমাজের কাছথেকে যেমন পেয়েছি, তেমনি তাকে যে কিছু দেবারও আছে - এই বিষয়ে আমরা কি শিখেছি, এবং কি করেছি, তার বিশ্লেষণের অতি প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতনের চারদিকের গ্রামের উন্নয়ন যদি না হয়ে থাকে, তাদের পল্লী জীবন যদি আমাদের শহুরে বাঙালীর তুলনায় শোষিত এবং কন্দ হয়, তবে বিশ্বভারতীর একশো বছরের অস্তিত্ব ব্যর্থ হয়েছে ধরতে হবে। স্বীকার করতে হবে যে এটা আমাদের সবার এক মর্মান্তিক ব্যর্থতা - ক্ষমার অযোগ্য ব্যর্থতা। আমরা তোতাকাহিনীর তোতার মত রবীন্দ্রনাথের রচনার ছোট ছোট টুকরো মুখস্ত করে তার পুনরাবৃত্তি করতে শিখেছি এখানে সেখানে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বানী হৃদয়ঙ্গম করতে শিখিনি। আমরা রবীন্দ্রনাথের তোতাপাখি হবার যোগ্যতা অর্জন করেছি, কিন্তু তাই কি গুরুদেব চেয়েছিলেন? আমাদের প্রকৃত সফলতা কোথায়?

রবীন্দ্রনাথ গ্রাম বাংলার অবনতি সারা দেশের ও সমাজের অবনতির একটি মূল কারণ হিসেবে দেখেছিলেন, এবং সমাজকে তার থেকে উদ্ধার করা শান্তিনিকেতনের শিক্ষাপদ্ধতির প্রথম ও অন্্যতম প্রধান করণীয় কর্তব্য ভেবেছিলেন। তিনি এও বুঝেছিলেন, এবং লিখেও গেছিলেন, যে শিক্ষিত বাঙালি শহুরে ভদ্রলোকগোষ্টি নিযেদের অশিক্ষিতদের চেয়ে এতই শ্রেয় মনে করে যে তাকে সমান চোখে দেখা বা সমান মানুষের মর্জাদা দেওয়া ওর অন্তর থেকপ আসেনা। তিনি শান্তিনিকেতনের শিক্ষক ও ছাত্রদের সেই জাতীয় ঔদ্ধত্য ও দম্ভ থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন, যাতে তারা পল্লীগ্রামের মানুষদের নিযের ভাইবোনের চোখে দেখে সেই জীবনের সত্যিকারের বিকাশের সন্ধানে প্রচেষ্ট হবে।

রবি ঠাকুর লিখছেন - আধুনিক কালে যন্ত্রের সহযোগে কর্মের শক্তি যেমন বহুগুণিত, তেমনি তার লাভ বহু অঙ্কের, আর সেই সঙ্গে সঙ্গে তার লোভ। এতে করেই ব্যক্তিস্বার্থের সঙ্গে সমাজস্বার্থের সামঞ্জস্য টলমল করে উঠছে। দেখতে দেখতে চারি দিকে কেবল লড়াই ব্যাপ্ত হয়ে চলেছে। এইরকম অবস্থায় গ্রামের সঙ্গে শহরের একান্নবর্তিতা চলে যায়, শহর গ্রামকে কেবল শোষণ করে, কিছু ফিরিয়ে দেয় না।
এই কথা আজকের পর্যবেক্ষকও মানবেন - এই নিরীক্ষণ পুরাতন নয় - আজকের দিনেও প্রাসঙ্গিক। কিন্তু, প্রশ্ন করি - আমরা কজন এব্যাপারে একমত? বড় কিছু ভাবার দরকার নেই, ছোট থেকেই ভাবি, শান্তিনিকেতনের সঙ্গে গ্রাম বাংলার আবার পরি য়ের দরকার অাছে - তা নিয়ে একটা কি দুটো প্রস্তাব নিয়ে কি আমরা একমত হয়ে হাত মেলাতে পারি নিজের সামর্থ মত?

যেমন ধরুন - গ্রামাঞ্চলের আজ কি অবস্থা - কতজন ভালো করে জানেন? যদি না জানেন. তবে আমরা কি একমত হতে পারি যে গ্রাম সম্বন্ধে প্রতম কাজ হল তাকে চেনার, এবং কি ভাবে তা করা যায় তার চিন্তা?

আরেকটা বলি - পৌষ মেলা। আমরা কি কয়েকটা মৌলিক বিষয়ে একমত হতে পারি, পৌষ মেলার মূল উদ্দেশ্য কি এবং সেটা ঠিক ঠিক নির্বাহ করা হচ্ছে, না তাতে উন্নতির সুযোগ আছে?

আমরা তো কত বিষয়েই প্রাক্তনীরা একজোট হয়ে গান বাজনা পিকনিক ইত্যাদি করি। এই ওপরের দুএকটি বিষয়ের মত কিছু ছোটখাটো কাজ নিয়ে কি আলোচনা করা যায়না ?

রবীন্দ্রনাথ আরও লিখছেন - আজ গ্রামের আলো নিবল। শহরে কৃত্রিম আলো জ্বলল— সে আলোয় সূর্য চন্দ্র নক্ষত্রের সংগীত নেই। প্রতি সূর্যোদয়ে যে প্রণতি ছিল, সূর্যাস্তে যে আরতির প্রদীপ জ্বলত, সে আজ লুপ্ত, ম্লান। শুধু-যে জলাশয়ের জল শুকোলো তা নয়, হৃদয় শুকোলো। জীবনের আনন্দে মাঠের ফুলের মতো যে-সব নৃত্যগীত আপনি জেগে উঠত তারা জীর্ণ হয়ে ধুলায় মিলিয়ে গেল। প্রাণের ঔদার্য এতকাল আপনিই আপনার সহজ আনন্দের সুন্দর উপকরণ আপনিই সৃষ্টি করেছে— আজ সে গেল বোবা হয়ে, আজ তাকে কলে-তৈরি আমোদের আশ্রয় নিতে হচ্ছে-যতই নিচ্ছে ততই নিজের সৃষ্টিশক্তি আরো অসাড় হয়ে যাচ্ছে।
পল্লীগ্রামকে এই অসহায় অবস্থার থেকে আজও মুক্তি দিতে পারেনি দেশ। রবীন্দ্রনাথের অবদান ছিল দেশের অপেক্ষায় বসে না থেকে নিজেদের সামর্থের মধ্যে একাজে নেমে পড়তে - এবং তার একটা কারণ হল এটা আমাদের সবার যে একটা সামাজিক কর্তব্য থাকা দরকার, সেই বোধটা আনতে। সব কাঝ সরকার করতে পারপ না - সরকার তো আপনাকে আমাকপ নিয়েই। আমরা নিজেরাই যদি সাংগঠনিক কাজে হাত লাগাবার অভ্যেস করি, তবে সাথে সাথে সমাজেরও অভ্যেস উন. নত হবে, সরকারেরও।

আমাদের উচিত ছিল ছোট করে কিছু গ্রামের সর্বাঙ্গিক বিকাশের কাজে হাত লাগানো এবং প্রাক্তনীদের সংগঠনে অন্যান্য কাজের সঙ্গে এই কাজে হাত লাগাতে। তা না করে, আমরা যে যার পেশা ধরে ওপরে ওঠাতে এতই ব্যস্ত ছিলাম যে ঋষি ঋণ তো দূরে থাক, নিজের পদোন্নতি এবং স্বজনপোষণ ছাড়া আর কোনও বহির্মুখী কর্তব্যবোধ নিয়ে চিন্তার ফুরসতমাত্র পাইনি।

পিয়ালি
আমার মনে আছে, আমাদের প্রাক্তনী বিষয়ক কথাবার্তা শুধু ঘোরাফেরা করতো আশ্রমিক সংঘ এবং alumni association’কে নিয়ে। তারপর ২০০৮ সালে SASI হবার পর কিছুদিন তাই নিয়ে উত্তেজনা ও নানাপ্রকার হুজুগ চললো। আমরা শান্তিনিকেতনের সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া সম্পর্ক পুন: স্থাপনের চেষ্টায় কত দৌড়োদৌড়ি করলাম, alumni association বা আশ্রমিক সংঘ, SASI প্রভৃতি ছাড়াই। পিয়ালি তো কলকাতার প্রাক্তনী দলের একরকম নেতৃত্ব নিয়ে মাসে মাসে শান্তিনিকেতন গিয়ে প্রাক্তনিদের সঙ্গে পাঠভবনের ছাত্রছাত্রী শিক্ষক শিক্ষিতাদের নতুন করে আত্মীয়তাবোধ বাড়াতে কত চেষ্টাই না করলো। খেলার মাঠের দূরবস্থা নিয়ে সতুদার চেষ্টা কিছু কম নয়। সতুদা শান্তিনিকেতনবাসী প্রাক্তনীদের ঘরে ঘরে গিয়ে অনুরোধ করেছে পাঠভবনের খেলার মাঠে ওদের সঙ্গে সময় দিতে একটা শিক্ষকও রাজি নন, তাই প্রাক্তনীরা যদি পালা করে একেকদিন একেকজন এসে মাঠে দাঁড়ান, তবে ছাত্রদের বিকেলের খেলাধুলো, যা বন্ধ হয়ে যাবার মুখে, তা আবার চালু করা যায়। ভাবতে কষ্ট হয়, সতুদার সঙ্গে হাত মেলাতে একটাও প্রাক্তনী এগিয়ে আসেনি - একটাও না। রোজ আসার দরকার নেই, মাসে একদিন ও যদি কিছু retired লোকেরা, যারা আগে ভাল খেলোয়াড় ছিল, তাদের একটু সঙ্গ দিত, কত ভাল হত। নিঃস্বার্থে সাহায্য করতে একজনও আসেনি সেদিন। সেই সব প্রাক্তনীরা ওখানে পড়েছেন, চাকরি করেছেন, তাঁদের বাবা মারা পর্জন্ত অনেকে শান্তিনিকেতনে চাকরি করেছেন। এরকম প্রাক্তনীদের কাছে এরকম প্রতিক্রিয়া হবে আমরা ভাবতেও পারিনি - স্তম্ভিত হবার মত খবর, এবং স্তম্ভিতই হয়েছি - লজ্জায় মাথা কাটা যাবার অবস্থা।

সতুদা
মনে আছে আমরা কিছু লোকে মিলে বিশ্বভারতীর উপাচার্য শ্রী রজতবাবুর সঙ্গে দেখা করি ২০০৮ সালে মেলার সময়। সঙ্গে ছিলেন তখনকার প্রাদেশিক রাজ্যপাল শ্রী গোপালকৃষ্ণ গান্ধী। সেসময়ে শিল্প সদনকে অার্থিকবাবে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টায় সাহাজ্য করতে এবং UGC’র প্রতিবন্ধকতার থেকে রক্ষা করতে উপাচার্য মশাই আমাদের কাছে অপ্রত্যাশিত ভাবে হঠাৎ পাঁচ লাখ টাকা seed money হিসেবে চেয়ে বসলেন। সেই প্রাক্তনী দলে অনেক রথী মহারথী ছিলেন। মজার ব্যাপার এবং দুঃখের ব্যাপার এই যে, উপাচার্যের সেই আহ্বান তখনই নাকচ না করেও, পরে সেই টাকা জোগাড়ের প্রতি কোনও আগ্রহ দেখা গেলনা প্রাক্তনীদের থেকে। সবটাই যেন শুধু কথা আর তার ওপর আরও অর্থহীন কথা - এতদুরই প্রাক্তনীদের দৌড়। কথাকে কাজে নামনোর শিক্ষা আমরা পেয়েছি কিনা তা।

তাপসদা
শেষ অবধি মনে আছে শুধু আমি আর তাপস দা, যিনি সেই মিটিংয়ে ছিলেনও না, নিজেদের পুঁজি হাতড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেগিস্ট্রারের সঙ্গে কথা বলে ধাপে ধাপে সাধ্য মত টাকা পাঠানো হল এবং যতদূর জেনেছি কাজেও দিয়েছে। শিল্প সদন গ্রামের কারিগরদের নিয়ে নানা সৃষ্ট বস্তুর উৎপাদন ও বিক্রয়ের প্রণালী খোঁজার চেষ্টায় ছিল। সেসময়ে একমাত্র সতুদা চেষ্টা করেছিল বাইরের ধনিক বা investor’দের এনে শিল্প সদনকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছিলেন। আর কেউ আসেনি এগিয়ে।

রবীন্দ্রনাথ বত্রিশ বছর বয়সে লিখেছিলেন - সংসারে সবাই যবে সারাক্ষণ শত কর্মে রত, তুই শুধু ছিন্নবাধা পলাতক বালকের মতো, মধ্যাহ্নে মাঠের মাঝে একাকী বিষণ্য তরুচ্ছায়ে, দূরবনগন্ধবহ মন্দগতি ক্লান্ত তপ্তবায়ে, সারাদিন বাজাইলি বাঁশি । ওরে তুই ওঠ আজি; আগুন লেগেছে কোথা? কার শঙ্খ উঠিয়াছে বাজি জাগাতে জগৎ-জনে?
কি মনে করে তিনি লিখেছিলেন এই বেদনাদায়ক কবিতা? কোন অন্ধকারামাঝে জর্জর বন্ধনে অনাথিনী মাগিছে সহায়? স্ফীতকায় অপমান অক্ষমের বক্ষ হতে রক্ত শুষি করিতেছে পান লক্ষ মুখ দিয়া; বেদনারে করিতেছে পরিহাস স্বার্থোদ্ধত অবিচার; সংকুচিত ভীত ক্রীতদাস লুকাইছে ছদ্মবেশে ।
রামপুরে বসে তিনি এই দীর্ঘ কবিতা লেখেন - কবি, তবে উঠে এসো — যদি থাকে প্রাণ তবে তাই লহো সাথে, তবে তাই করো আজি দান । বড়ো দুঃখ, বড়ো ব্যথা — সম্মুখেতে কষ্টের সংসার বড়োই দরিদ্র, শূন্য, বড়ো ক্ষুদ্র, বদ্ধ, অন্ধকার । অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু, চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ-উজ্জ্বল পরমায়ু, সাহসবিস্তৃত বক্ষপট । এ দৈন্যমাঝারে, কবি, একবার নিয়ে এসো স্বর্গ হতে বিশ্বাসের ছবি ।

এই সব টুকরো টুকরো খবর, অভিজ্ঞতা ও কাহিনীকে জালের মধ্যে বুনে, একটা নকশা তৈরি করছি মনে - রবীন্দ্রনাথ, কালীমোহন, ভারত সরকার, রাজ্যপাল, উপাচার্য, অধ্যক্ষ, মন্ত্রী, রাজনিতীজ্ঞ, বামপন্থী, দক্ষিণপন্থী, আমেরিকা, রাশিয়া, ভগবান ইত্যাদি বহিরাগত ছোঁয়াচ ছেড়ে আমরা নিজেরা কি করেছি বা করিনি তার চিত্রই উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।

এই ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের পল্লী উন্নয়নের কথা লেখাটা কষ্টসহিষ্ণু কাজ - উনি কি ভেবেছিলেন বা চেষ্টা করেছিলেন, এবং কালীমোহনের চেষ্টা কোন দিকে গেছে, তা নিয়ে নয়। আমরা পরের প্রজন্মের লোকেরা তা নিয়ে কি করিনি তা দেখতে হয় বুঝতে হয় - সেটাই কষ্টদায়ক। তবে এই চিন্তা মনে হয় আমার একার নয়। আড্ডাদেবার সময় বাঙ্গালুরুর টুকুল, মিরিশাসের পিয়ালি এবং বিলেতের তাপসদা মনে হয় একই মতভাবাপন্য - কমবেশি। আরও হয়তো আছেন এমন চিন্তাধারার লোক - তাদের অপেক্ষায় আছি। ঠিক ঠিক কয়েকটি লোক পাওযা গেলে তাদের সঙ্গে হাত মেলানো যায়, দুয়েকটি ছোট ছোট কাজের বদলে বৃহত কাজে নামা যায়, কত চেষ্টা করা যায় ঋষি ঋণের শোধবোধের হিসাব মেলাতে। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঠিক রুপ ও বিকাশ কোন পথে তা নিয়ে চিন্তা করা এবং ক্ষমতা অনুযায়ী চেষ্টা করা বিশ্বভারতীকে সেই দিকে ঠেলা।

টুকুল
অনেকদিন আগে এক স্কাইপস্থ বিশ্বআড্ডার সময় এই দেনা শোধের কথা ওঠে - এবং পিয়ালিই আমাদের জানায়, তখনকার দিনে লোকেরা ঋষি মুনির কাছে বিদ্যার্জন করতে গিয়ে তারপর যে দেনা বোধ করে, তাকে ঋষি ঋণ বলা হত। কথাটা আমাদের পছন্দ হয়। তাপসদার ব্যবহৃত শব্দতালিকায় ঋষি ঋণ কথাটা বিশেষ স্থান পায় সেই থেকে। এই ব্যাপারে আমাদের কি করণীয় তা এখনও আমাদের মনে স্পষ্ট নয়, তবে এটুকু বুঝি যে কিছু না করার চেয়ে চেষ্টা করে বিফল হওয়া ভাল - অন্তত তাতে শেখা যায় কোন পদ্ধতি কাজের আর কোনটাতে বিফল হবার সম্ভাবনা বেশি।

ভারতবর্ষের তৎকালীন শিক্ষাব্যবস্থার মুখস্তবিদ্যা যে দেশের দীনদরিদ্রের কোনও কাজেই আসছেনা তা উল্লেখ করে, তার সঙ্গে গান বাজনা ছবি আঁকা এবং আনন্দ করার ও আত্মপ্রকাশের রাস্তাও বন্ধ থাকার পরিনাম কি ক্ষতিকর তা উল্লেখ করেছেন গুরুদেব। মজার ব্যাপার এই যে, একষট্টি বছর বয়সে তিনি যা লিখেছেন তা কিন্তু নব্য জাগরিত মধ্যবিত্তদের জন্যই নয় - সমস্ত দেশবাসীর জন্য, বিশেষ করে পল্লীগ্রামের লোকেদের কথা ভেবে। আজকের বাঙালি সমাজের রবীন্দ্রচর্চা নিয়ে আমার সবচেয়ে বড় নালিশ হ’ল - রবীন্দ্রানুরাগীরা সেই সঙ্গীত, ছবি আঁকা, নৃত্য, কবিতা, আনন্দ, সবকিছু শুধু বিলি করছেন রাজধানী আর শহরে শহরে। পল্লীপ্রকৃতির লোকেরা সেই আনন্দ থেকে বঞ্চিত। তাদের ছবি আঁকার না আচে সময়, না জেগেছে সৌন্দর্যবোধের নবচেতনা, আর আধপেটা খেয়ে না আছে মনবৃত্তি। বড়জোর শহুরে চিত্রকাররা, যারা একটা ঘোড়ার লেজও ভাল করে আঁকতে সেখা দরকার বোধ করেনি, অথচ ধনীদের কাছে যাদের চিত্রকলার প্রচুর চাহিদা, তারা মাঝে মধ্যে পৃথিবীর দুঃখি মানুষের কষ্টবোধ করে একটি যেমন হোক ছবি আঁকেন, এবং তা হয়তো বা বড় দামে নিলাম হয়ে যায়। নিলাম ঘরে বিজ্ঞ চিত্র সমালোচকরা হাততালি দেন। যাকে নিয়ে ছবিটি আঁকা, সে জানতেও পারেনা, এবং তার জীবনে ছবি আঁকা তো দুরে থাক, সে তখনও আধপেটা খেয়ে কোনও গাছের তলায় ধুঁকতে থাকে।

আমি মাঝে মধ্যে প্রশ্ন করেছি, রবীন্দ্রনাথের ১৫০তম জন্মদিন বিদেশে করার কি প্রয়োজন, যখন তার নিজের দেশেই তার কাজ এত অসম্পুর্ণ হয়ে আছে। সঠিক জবাব এখনও পাইনি।

রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - গ্রামের উন্নতি সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করব আমার উপর এই ভার। অনেকে অন্তত মনে মনে আমাকে জিজ্ঞাসা করবেন, ‘তুমি কে হে, শহরের পোষ্যপুত্র, গ্রামের খবর কী জান। ' আমি কিন্তু এখানে বিনয় করতে পারব না। গ্রামের কোলে মানুষ হয়ে বাঁশবনের ছায়ায় কাউকে খুড়ো কাউকে দাদা বলে ডাকলেই যে গ্রামকে সম্পূর্ণ জানা যায় এ কথা সম্পূর্ণ মানতে পারি নে। কেবলমাত্র অলস নিশ্চেষ্ট জ্ঞান কোনো কাজের জিনিস নয়। কোনো উদ্দেশ্যের মধ্য দিয়ে জ্ঞানকে উত্তীর্ণ করে নিয়ে গেলে তবেই সে জ্ঞান যথার্থ অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়। আমি সেই রাস্তা দিয়ে কিঞ্চিৎ পরিমাণে অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। তার পরিমাণ অল্প হতে পারে, কিন্তু তবুও সেটা অভিজ্ঞতা, সুতরাং তার মূল্য বহুপরিমাণ অলস জ্ঞানের চেয়েও বেশি।

তিনি বুঝতে পারছিলেন যে যাঁরা তাঁর কথা মানছে, তারাও মেনে নেওয়া ছাড়া আর কিছু করতে রাজি নয়, একটি কড়ে অাঙুলও তুলবে না। আর যারা মানছে না, তারা যা করছে শুধু রবীন্দ্রনাথকে দেখাবে বলে করছে, সত্যিকারের পল্লী উন্নয়নের জন্য নয়। সেই জন্য তিনি বুড়ো বয়সে চেষ্টা করলেন নিজেই যদি কয়েকটা গ্রামে যদি শিক্ষা, স্বাস্থ, আর্থিক স্বনিরভরতার ভার সবাই হাত মিলিয়ে করতে পারেন তবে নজ সাধ্য মত দেশের কল্যানের কাজ কিছুটা এগিয়ে দিতে পারবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু তাতেও তিনি যে সফল হননি তা নিজেই লিখে গেছেন দুঃখ করে, পল্লী প্রকৃতিতে। নিস্ফলতার কারণও লিখেছেন - শিক্ষিত লোকের মনে অশিক্ষিত জনসাধারনের প্রতি একটা অস্থিমজ্জাগত অবজ্ঞা অাছে। যথার্থ শ্রদ্ধা ও প্রীতির সঙ্গে নিম্নশ্রেণীর গ্রামবাসীদের সংসর্গ করা তাদের পক্ষে কঠিন। আমরা ভদ্রলোক, সেই ভদ্রলোকদের সমস্ত দাবি আমরা নীচের লোকদের কাছ থেকে আদায় করব, এ কথা আমরা ভুলতে পারি নে।

এই অস্থিমজ্জাগত অবজ্ঞা এখনও আছে এবং আমাদের প্রাক্তনীদের মধ্যে বিশেষ করে আছে মনে হয়। এই সাংস্কৃতিক অন্ধতা চটকরে যাবার নয়।

তোমার আসন হতে যেথায় তাদের দিলে ঠেলে - সেথায় শক্তিরে তব নির্বাসন দিলে অবহেলে।
চরণে দলিত হয়ে ধুলায় সে যায় বয়ে, 
সেই নিম্নে নেমে এসো, নহিলে নাহি রে পরিত্রাণ ।

কে কার কথা শোনে। বিশ্ব ভারতী এখন চারদিকে দেয়াল তুলতে ব্যস্ত - এবং প্রাক্তনীরা ব্যস্ত গান গাইতে আর একে অন্যের পিঠ চাপড়াতে। সুতরাং এই অবস্থা থেকে বিশ্বভারতীকে মুখ ঘোরানোর মত লোক পাওয়াটাও একটা কাজ। দেখা যাক কি হয়। তবে প্রাক্তনীদের কোনো দিন চোখ খুলবে কিনা এবং তাদের দ্বারা কিছু গঠনমূলক কাজ আদৌ হবে কিনা সন্দেহ করার করণ আছে। যখনই শান্তিনিকেতনের আদর্শবাদ রক্ষার জন্য এবং তার পুনরূদ্ধারের কাজে হাত মেলিয়ে এগোনোর দরকার হয়েছে, তখনই দেখা যায় আসেপাসের সমস্ত রবীন্দ্র-প্রণয়ীরা হঠাৎ অন্যত্র নানা দরকারি কাজের সন্ধান পেয়ে অতি ব্যস্ততার সঙ্গে দিন কাটাচ্ছেন এবং শান্তিনিকেতনের সংগঠনকাজে নেহাতই অসুবিধের কারণে এই মুহুর্তে যোগ দিতে তাঁরা অক্ষম। যত নামী দামি রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞের দিকে তাকানো যায়, এই কাজ এড়িয়ে যাবার শৃঙ্খলায় তাঁরা ততোধিক দক্ষ।

একটু একটু করে এই সব লেখা তুলবো, তার শব্দ ও বাক্য সংগঠন নিয়ে নাড়াচাড়া করব। আপনাদের বক্তব্য শোনার ইচ্ছে রইল - এই ব্লগের তলায় তার ব্যবস্থা করা আছে - পারলে জানাবেন মতামত 
তনু

No comments: