Search This Blog

Wednesday, June 15, 2011

দেবী চৌধুরাণীকে নিয়ে ত্রিকোনমিতি

এক কাপ কফি নিয়ে বসন্ত তাকিয়ে ছিল জানালার বাইরে। পরিষ্কার নীলাকাশে ঝলমল করছে রোদ্দুর। জুন মাসের পনের তারিখ - তাপমাত্রা বাইরে বারো ডিগ্রি। হালকা জ্যাকেট পরে লোকেরা রোদে বেরিয়েছে দোকান করতে, বা পাবে বিয়ার খেতে। কেউবা চললো খেলা দেখতে - এখানে লোকেরা তাকে হকি বলে। বসন্তের দেশের লোকেদের কাছে - অাইস হকি।

রেস্তোরাঁর এক নিভৃত কোনে, একটা সোফাতে বসে, বসন্ত তার নোটবইটা নাড়াচাড়া করলো। ছোটবেলা থেকে নোটবই সঙ্গে রাখার অভ্যেসটা অাজও কাটেনি। তবে অাজকাল ও অনেক সময় পকেট নোটবইয়ের বদলে যা নিয়ে অাসে তা অনেক বড় এবং পকেটে ঢোকার মত নয়।

সঙ্গে জান্ত্রিক পেনসিল। এতদিন কলম এবং বলপেন ব্যবহার করা সত্যেও, পেনসিলের অাকর্ষণটা ওর কাটেনি। কাপে চুমুক দিয়ে বসন্ত নোটবইয়ের পাতা ওল্টালো অন্যমনষ্ক ভাবে। সারাদিন অাপিস করে মানসিক ভাবে অল্প ক্লান্ত বোধ করছিল, তাই এই নির্জন টেবিলে বসে চুপচাপ কফি খাওয়া। অাপিসে সারাদিন গেছে একটা টেকনিকাল দুর্ঘটনা বিস্লেষণ করে এবং তাই নিয়ে রিপোর্ট  লিখে, যাকে মূল শিকড় বিশ্লেষণ বলা যায়, কারণ ইংরিজি তাকে ‘রুট কজ এনালিসিস’ই বলে থাকে। যাই হোক, ওরকম নিরস বিষয়ে ডুবে থেকে বসন্ত হাঁপিয়ে গেছিল।

নোটবইয়ে হিজিবিজি অাঁকতে গিয়ে খেয়ালই হয়নি কখন অর্ধসচেতন অবস্থাতে ও শর্বানী মুকুলের নাম লিখে ফেলেছে। শর্বানী একটি ভারতীয় অর্ধ বাঙালি মেয়ে, এখানে হষ্টেলে থেকে কলেজে পড়ে। বস্তর সঙ্গে অালাপ হয়েছে মাস খানেক হলো মেয়েটি হাসিখুসি এবং চটপটে। দেখতে অাজকালকার মেয়েদের মতই চলনসই। বসন্তের সঙ্গে মোবাইল নম্বর অাদান প্রদান হয়ে গেছে কিছুদিন হল। অাজ ও মোবাইলে বার্তা রেখেছে - শনিবার কিছু করার পরিকল্পনা অাছে কিনা প্রশ্ন করে। মেয়েটির ডাক নাম বানী। বসন্ত এখনও বানীর সঙ্গে একা কোথাও যায়নি - তবে মনে হয় যাবার রাস্তা হয়তো বানীর তরফ থেকে খোলা।

অাঁকিবুকি করতে করতে শর্বানী হয়ে গেল একটা অালপনা, তারপর একটা বিরাট গাছ, এবং তা থেকে জঙ্গল। জঙ্গলের একপ্রান্তে ওটা কি? অাবার একটা মেয়ে না? বসন্ত মন দিয়ে দেখলো । তারপর, সেই কোনায় অাঁকা মেয়ের পাসে বাংলাতে লিখলো ‘মেরি’। বানী থেকে মেরি?

কফিটা শেষ করে বসন্ত হাত তুলে রেস্তোঁরার মেয়েটিকে ইসারা করলো, অারেক কাপের জন্য। থুতনিটা কনুইয়ের ওপর চাপিয়ে অাবার কিছুক্ষণ দেখলো বাইরের অাকাশ।

মেরি বসন্তের অাপিসের পাসের বাড়িতে চাকরি করে - বীমার কাজে; গাড়ি, বাড়ির ইনসুরেন্সে। মাঝে মধ্যে বসন্তের সঙ্গে দুপুরে স্যান্ডউইচ খেয়েছে নিচের কোরিয়ান রেস্তোঁরাতে। সেও বসন্তকে তার মোবাইল দিয়েছে এবং ওর সঙ্গে পাখি দেখতে যাবার ব্যাপারে উৎসাহ দেখিয়েছে। মুশকিল হল, বসন্ত বুঝতে পারেনা সেটা নেহাতই ভদ্রতাজনক, না সত্যিই তার পাখি দেখার উতসাহ, না বসন্তের সঙ্গে সময় কাটাতে তার ভাল লাগে।

বসন্তের এটা একটা বিশেষ সমস্যা - ও মহিলাদের চটকরে বুঝতে পারে না।

অারেক কাপ কফি, ও তার সঙ্গে ছোট্ট দুধের প্যাকেট ও চিনি দিয়ে গেল রেস্তোঁরার মেয়েটি। বসন্ত দেখলো, তার নোটবইয়ের মেরি, কখন যেন জলজ্যান্ত একটি স্বপ্নরুপে তার চোখের সামনে ভাসছে। তবে ওর অাপিস পাড়ার সেই মেরি এ নয়। এর গায়ের রং পান দেওয়া তামার মত। পরনে একটি অল্প ময়লা ঘাগরা অার তার সঙ্গে একটা ঢিলে জামা। গলায় ধুতরো বিচির মালা, তাতে কয়েকটি জবাফুল গাঁথা। খালি পা, হাতে একটি তালপাতার ঠোঙায় অাছে কয়েকটি তিলের মোয়া। জঙ্গলের ধারে সে ব্যস্ত হয়ে হাঁটাহাটি করছে একটি বিরাট শিমুল গাছের তলায়।

নাম তার মেরিয়াম। লোকে মেরি বেগম বলে। এতটুকু ভেবে, বসন্থ থামলো, ভুরু কুঁচকে। বেগম মেরি বিশ্বাস নামে একটা উপন্যাস বেরিয়েছিল না? বিমল করের, না বিমল মিত্র? বসন্তর সবসময়ে ঐ দুটি নাম গুলিয়ে যায়। যাই হোক, বসন্তের মেরি সেই বেগম মেরি বিশ্বাস নন।  এমটু চিন্তা করে বসন্ত তার অাপন মেরির নাম পাল্টে মেরি সাঁই রাখলো। মেরি সাঁই কেন? কারণ, সে জঙ্গল সাঁই’য়ের পালিতা কন্যা। জঙ্গল সাঁই ? সে কোথা থেকে এল হঠাৎ? বসন্ত নতুন কাপের কফিতে এক চুমুল দিয়ে লক্ষ করলো চিনি দুধ ঢলতে ভুলে গেছে।

কফিটা ঠিক করতে করতে বসন্ত চিন্তা করল জঙ্গল সাঁইকে নিয়ে। সে কিকরে মেরিকে পালিত করলো, সেটা পরে হবে। জঙ্গল সাঁই নিজে অর্ধেক সাঁওতাল এবং অর্ধেক অন্যকিছু। কেউ বলে অন্যার্ধটা তুর্কি মুসলমান, কেউ বলে অাবার উত্তর ভারতের ব্রাহ্মণ, অাবার কেউ বলে নেপালী। বাকি অর্ধটা যাই হোক, জঙ্গল সাঁই তার নামটি পায় মঙ্গল সাঁইয়ের কাছে। মঙ্গল সাঁই ময়মনসিংহে অনেকদিন এক জমিদারের গায়ক ছিল- মনের মানুষের গান গাইত। পরে একদিন কথায় কথায় ওর সঙ্গে জমিদারের হিন্দু ও মুসলমান ভাগিদারদের সাথে গোলমাল লাগে। তারা জানতে চায় মঙ্গল সাঁই হিন্দু না মুসলমান, না বৌদ্ধ না কি? একটা সুরাহা না করলেই নয়, এবং সে যেই ধর্মাবলম্বী হবে, তাকে সেই মতে চলতে হবে।

মঙ্গল তার ধর্মটা যে কি. তা নিজেই জানতো না, এক মানবধর্ম ছাড়া। তাই সে জনিদারের কাছে বিদায় নিয়ে যাত্রা শুরু করলো গ্রাম থেকে গ্রামে। এবং মানব ধর্ম ছাড়াও কোনো উৎকৃষ্ট ধর্ম অাছে কিনা তার সন্ধানে। অনেক বছর কেটে যায়। মানবধর্মের চেয়ে উৎকৃষ্ট কিছু পেয়েছিল কিনা জানতে চাইলে ও উত্তর দেয় যে, এক ফেউ ডাকা জঙ্গলে তার সঙ্গে বালক ভবঘুরে জংলার দেখা, যে তার অনুচর ও একপথযাত্রী হ’য়ে যায়। সেই থেকে জংলা হল তার সাথি, এবং জংলার নামও পাল্টে হ’য়ে গেল জঙ্গল সাঁই। সুতরাং মঙ্গল তার জীবনে মানবধর্মের পর, জঙ্গল সাঁইকে সাথি পাওয়াটাই উচ্চধর্মলাভসমান মনে করেছে।

অাজ সেই মঙ্গল সাঁই নেই । সে মানবধর্মের ওপরশ্রেনীর খোঁজে ইহলোক ত্যাগ করেছে এবং পরলোকে কিছু পেল কিনা তার খবর পাঠায় নি। তার চেলা জঙ্গল সাঁই দুই তিনটি অাদিবাসী দলের কখনো সখনো নেতা অাবার কখনও বা উপদেষ্টা। এবং, সেও  এক ধুতরো গাছের তলায় গঙ্গাপারে কুড়িয়ে পাওয়া অর্ধসাহেব অর্ধ দেশি সদ্যজাত মেয়েকে পালন করেছে, নাম দিয়েছে মেরিয়াম, বা মেরি সাঁই। সেও অাঠারো বছর অাগের কথা। সুতরাং, জঙ্গল সাঁইয়ের উচ্চধর্মসন্ধানের উত্তর সে পায় গাৎতলায় কড়িয়ে পাওয়া মেরির মধ্যে।

জঙ্গল সাঁইয়ের তেঝ অাজকাল কিছু কমেছে - মহুয়া রস অার কালোজামের তাড়ি খেয়ে পেটটাও গেছে ফুলে, মাথার ঝাঁকড়া চুলও হালকা, তাতে পাকও ধরেছে। ডুঙ্গিপাড়া গ্রামের লোকেরা ওকে সর্দার ডাকে। সেই পাড়তেই সে থাকে। কন্যা মেরি মাসে দুমাসে লোক পাঠায় খবর নিতে, কিছু অর্থ সাহাজ্য করতে, এবং বছরে একবার নিয়ে অাসে বাপকে নিজের বাসায় মাস কাটাতে।

মেরির অাজকাল পদোন্নতি ঘটেছে। ও হ’ল রমনীমোহন বাবুর রক্ষিতা। রমনী বাবুর দুটি স্ত্রী। কিন্তু তাঁর সবচেয়ে প্রীয়া হল মেরি সাঁই। মজার ব্যাপার হল, মেরি রমনীমোহন বাবুর রক্ষিতা হলেও, ভালবাসে ফল্গু মাঝিকে।

বাবাঃ, এখানেও ভালবাসার ত্রিকোন? বসন্ত একটু হেসে দ্বিতীয় কাপের কফি শেষ করল। এবার ওঠার সময় হয়েছে। কালও অাপিস অাছে।

অাসলে ব্যাপার হল - ত্রিকোন শুধু একটা নয়, নানারকম। যেমন, রমনীমোহনবাবুযে একেবারেই জানেননা মেরির মনের গোপন বাসনা তা নয়। অাবার তার ওপরে, উনি হলেন ডেপুটি কালেক্টার সাহেবের কর্মচারি এবং খাজনা জোগাড় করার ব্যাপারে যুক্ত। তাতেই শেষ নয়। ফল্গু মাঝির প্রধান উপার্জন হল ইস্ট ইন্ডিয়া ম্পানির রানার হিসেবে। রমনী মোহন বাবু যে মেরির দুই নৌকতে পা দেওটা সহ্য করেন তার বিশেষ কারণ অাছে। মেরি ফল্গু মাঝির কাছ থেকে যে সব খবর পায়, তা রমনীমোহন বাবুকে জানায়। একদিকদিয়ে বলা যায়় মেরির কাজের মধ্যে খবর অাদানপ্রদান হয়তো বাবুকে সঙ্গ দেওয়ার চেয়ে বেশি গরুত্বপূর্ণ মনে করেন রমনীমোহন।

তবে, মেরি কি রকম খবর দেয়, বা কিরকম খবর পায় ফল্গুর কাছে, তার চুলচেরা বিচারের এখনও সুযোগ অাসেনি রমনী বাবুর কর্মকর্তা ডেপুটি সাহেবের। সুযোগটা শিগগিরি অাসবে মনে হয়। ভবানী পাঠক এবং দেবী চৌধুরাণী নাকি অাবার কোম্পানীর টাকা বাটপারি করার অায়োজন করছে। একবার যদি তাদের ধরা যায়, তবে রমনীমোহন বাবুর রায়বাহাদুর বা কালেক্টারির একটু ছিঁটেফোঁটা পাবার সম্ভাবনা বাড়বে।

রমনী বাবুর জানা নেই যে ফল্গু মাঝি যেমন কাজ করছে, তাতে ওরকম লোকদের ভবিস্যতের সমাজ ডবল এজেন্ট নাম দেবে। বর্তমানে এই সম্প্রদায়ের কোনো নাম নেই, গুপ্তচর ছাড়া।

ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরাণীর মাপাজোপা খবর যেমন ডেপুটি সাহেবের কাছে পৌঁছচ্ছে, তেমনি উল্টো দিকেও খবর পাচার হ’য়ে যায় - কবে কোথাদিয়ে কত টাকার খাজনা কোন তহবিলে কি ভাবে পাঠানো হবে, সঙ্গে প্রহরাদার কজন, কিধরণের অস্ত্র  ব্যবহার করবে তারা - কোন গ্রামের লোক তারা ইত্যাদি।

মেরি এসবের কতখানি বোঝে এবং কতটা অবুঝ, রমনীবাবু ঠিক অান্দাজ পাননি। মেরি মাঝিকে মনে মনে ভালবাসে, এতটুকুই জানা অাছে। বসন্ত মনে মনে ভাবলো, ভালবাসা, এবং গুপ্তচরগিরির ব্যাপারে অারও কয়েকটা ত্রিকোন অানলে বোধহয় মন্দ হয় না। যেমন দেবী চৌধুরাণী ও ভবানী পাঠিকের সঙ্গে অারেক মহিলা, ভবানীর পেছনে। দেবী চৌধুরাণীরও কিছু গুপ্ত প্রণয়ী রাখলে হয়তো মন্দ হয়না।

বসন্ত কফির পয়সা দিয়ে, খাতা পত্তর গুটিয়ে উঠলো রেস্তোঁরা থেকে। চুড়ান্ত হয় যদি অারেকটা ত্রিকোন অানা যায় - নগ্ন সন্যাসীকে নিয়। ধরো, নগ্ন সন্যাসীর অারেকটা পরিচয় অাছে, এবং তারও এক গুপ্ত প্রেমিকা উপস্থিত - অার কেউ নয়, স্বয়ং তরঙ্গীনি দেবী। তিনি কে ? কেন, রনমী মোহন বাবুর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী !

মুচকি হেসে বসন্ত বেরিয়ে এল জুন মাসের সন্ধ্যায়, ফুটপাথ দিয়ে একটু হাঁটতে। মেরিকে কালকে মোবাইলে ডেকে অাহ্বান করবে অাসতে শনিবার পাহাড়ি ঝরনার ধারে বল্ড ঈগল দেখতে যেতে। দুপুরে ওপাড়ায় খেয়ে ফিরবে। শর্বানীর পাখি টাখির তেমন উতসাহ নেই মনে হয়। ওর সঙ্গে কোনো সিনেমা দেখার প্রস্তাব দেবে কিনা বসন্ত ঠিক করে উঠতে পারছেনা।

ওদিকে দেশ থেকে ছোট বোন অার দাদা প্রায়ই খোঁচা মারে একটা বিয়ে করতে।

ঝামেলা !

No comments: