Search This Blog

Friday, June 3, 2011

দেবী চৌধুরানী নবদ্বীপে ?

ওয়ারেন হেস্টিংস মশাই কুয়াসাতে হারিয়ে গেলেও, ওনার গলার অাওয়াজ কানে অাসছিল কিছুক্ষণ - ঘোষ বাবুর ওপর চোটপাট এবং নিজের দুর্ভাগ্য নিয়ে গজ গজ করতে করতে ওর গলার অাওয়াজটা কুওর ওপারে বড় জাম গাছটার পেছনে হারিয়ে গেল। অামি বোধ করলাম অাপদ গেল, এবার সেই অাপাতদৃশ্যের এক কাপ চা টা খেয়ে ফেলি, অার বাকি রাখলে ঠান্ডা হ’য়ে যাবে।

কিন্তু তার কি উপায় অাছে এই জৈষ্ঠ মাসের বৃষ্টি ভেজা বিকেলে ?  কুয়াশার ভেতর বাঁ দিক থেকে নদী পারের কাঁকর ঢালা মাটির রাস্তায় শোনা গেল যেন ঘোড়ার খুরের অাওয়াজ, এবং সঙ্গে কোচোয়ানের টুং টাং ঘন্টি । ছা খাওয়া ভুলে দেখতে লাগলাম এক সৌখিন বাঙালি বাবুর চৌঘুড়ি চেপে গঙ্গার হাওয়া খেতে বেরোনো। অঞ্চলটা অাজকের দিনে কলকাতার শোভাবাজার। তখনকার দিনে লোক ছিল কম, বাজার ছিল বড়, অার শোভাটা তখনও পুরোপুরি অাসেনি।

চলেছেন নবকৃষ্ণ দেব মহাশয় - তখনও রাজা বা মহারাজা উপাধি পাননি, তবে পয়সা অনেক করে ফেলেছেন। ঊর্দু, ফার্সি, ইংরাজি, বাংলা, সব ভাসাতে পারদর্শী, তিনি হেস্টিংস সাহেবের প্রথমে অনুবাদক, পরে মুনশি, এবং তারও পরে হেস্টিংস ও রবার্ট ক্লাইভের সঙ্গে দোস্তি করে তিনি অনেক ফন্দিতে যোগ দেন, মীর জাফর, রামচন্দ্র রায়, অামীর বেগ ইত্যাদির সঙ্গে হাত মিলিয়ে, সিরাজ উদ্দৌলা কে বিপাকে ফেলে ক্লাইভের কাছে যুদ্ধে হার ঘটিয়ে, সিরাজের মৃত্যুর পর এরা কজনে সিরাজের প্রায় অাট কোটি টাকার গুপ্তধন এই কজন তার ভাগ বাঁটোয়ারা করে রাজা বাদশা লাটসাহেব বনে যান। সুতরাং, হেঁটে বা এক্কা ঘোড়ায় চাপার বদলে ওনার এখন চার ঘোড়ার টাঙ্গা - যাকে বাবু সম্প্রদায় এখন চৌঘুড়ি নাম দিয়েছে। তাতে চড়ে, কোঁচা দেওয়া ধুতি ও হরিনের চামড়ার নরম মুখবন্ধ চটি পরে, ফিনফিনে সিল্কের পাঞ্জাবি গায়ে, অাতর লাগানো রুমাল হাতে, পাসে ইয়ার দোস্ত কে বসিয়ে তিনি একটু হাওয়া খেতে বেরিয়েছেন। তার পর সন্ধ্যে হলেপর বাইজীর গান শোনার এবং অধিক রাত ওবধি শূরা পানের একটা পরিকল্পনাও অাছে।

মুশকিল হ’ল, গত তিন বছর হেস্টিংস সাহেব নবকেষ্ট যেই তিন লাখ টাকা ধার দিয়েছিলেন ওনাকে, ঘুষ বলাটা হয়তো খুব ভুল হবেনা, তা তিনি ফেরত দেননি, এবং মনে হচ্ছে ফেরত দেবার ইচ্ছাও নেই। ৎোভাবাজারের দুর্গা পুজোতে সাহেব মেমদের এনে নাচগান করিয়ে, পুরাতনী পুরুতদের চোখতো কপালে অানেকদিন হল উঠেছে। সয়ং রবার্ট ক্লাইভ সাহেব যখন নবকেষ্টর শোভাবাজারের পুজোতে অাসেন, এবং ওয়ারেন হেস্টিংসের প্রতিপত্তি যখন দিনে দিনে কমছে মনে হয়, এবং বর্ধমানের কালেকটারির ব্যাপারটা যখন পুরোপুরি উসুল হলনা, তখন ঔ তিন লাখটা ফেরত পেলে খুব চাজে লাগতো, এবং হেস্টিংসও শিখতো বাঙালির কাছে  কত ধানে কত চাল। কিন্তু হেস্টিংসের বিরুদ্ধে ইমপীচমেন্টের চেষ্টাটা পুরোপুরি সফল হলনা - বেটা ইংরেজরা যতই হোক, একটা বাঙালির কথায় হেস্টিংসের মত উচ্চপদের ইংরেজের অতীত ভবিষ্যত নষ্ট করতে রাজি হ’ল না।

নবকেষ্ট তার ইয়ার কুমার বর্মনকে এসব বলছে, অার গালাগাল দিচ্ছে হেস্টিংসের পুর্বপুরুষদের উদ্দেশ্য করে। অারই মধ্যে জানা গেল, গত মাসে নবকেষ্টর কালেকটারীর খাজনার নিজের ভাগটা কিছুটা হারিয়েছে - নবদ্বীপে নদীতে দেবী চৌধুরানীর অাক্রমনে, এবং বয়রার জঙ্গলে ভবানী পাঠকের ডাকাতিতে। শাহ অালমকে এসব কথা বলাও যায়না, অাবার তার সঙ্গে বনিবনাটা ঠিক মত না হ’লে নবকেষ্টের রাজা মহারাজ উপাধিটাও হাত ছাড়া হ’য়ে যেতে পারে।

এই সব বলতে বলতে চৌঘুড়ি চালিয়ে শোভাবাজারের হবু রাজা নবকৃষ্ণ দেব তার ইয়ারের সঙ্গে চলে গেলেন কুয়াশার গর্ভে, এবং রেখে গেলেন নানান চিন্তার খোরাক,  not the least of which হ’ল সেই দেবী চৌধুরানীর একটা নৌকোয় বাটপারির গন্ধ।

নবদ্বীপে কিরকম নৌকো কার কাছ থেকে কিরকম খাজনার কি ভাগবাটওয়ারা করে কত টাকা বা সোনা গয়না অানছিল নবকেষ্ট বাবুর জন্য, তার কতটা দেবী চৌধুরাণী লুঠ করতে পেরেছিল, কতটা নিজের জন্য রাখলো, কতটাই বা অন্যদের দিয়ে দিল - এই সব ভাবছিলাম। গাঁয়ের লোকেদের সাহাজ্য ছিল বলেই দেবী চৌধুরানী জলে এরকম ডাকাতি করতে পারতো - সুতরাং, গ্রামের লোকেরা, যাদের সর্বস্য দিয়েই এইসব খাজনা প্রথমতঃ যোগাড় হচ্ছিল, তারাও বোধহয় তাদের পুঁজির কিছুটা ফেরত পেত। বিলেতে যেমন রবিন হুড ছিল এক কাল্পনিক গরুবদের দস্যু, দেবী চৌধুরানী কি তেমনিই বাংলা দেশের রবিন হুড ? তবে উনি কাল্পনিক নন, এবং পুরুষও নন।

এই সব ভাবছি, তার মধ্যে কম্পুটারে random গানের সিলেকশানে হঠাৎ দেখি রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের গলায় বাবু কালচারের গান শুরু করেছে - অামি চৌঘুড়ি চালিয়ে যাব, সঙ্গেতে ইয়ার।

রামকুমার বাবুর গলাটা খুব মিষ্টি ছিল।
---------------------------
Ref: Nobkissen versus Hastings, Bulletin of the School of Oriental and African Studies, University of London, Vol 27, #2 (1964) page 382-396.
(তবে এলেখার বেশিটাই কাল্পনিক, যদিও নবকৃষ্ণের সঙ্গে হেষ্টিংসের মামলাটি ঐতিহাসিক)

2 comments:

Tonu said...

চেষ্টা চেষ্টা - test’এর চেষ্টা ॥

neptune said...

Khub bhalo hochchhe, chaliye jao